অপহরণের ৪৮ ঘণ্টা যেভাবে কেটেছে ব্যাংক ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনের

গতকাল উদ্ধারের পর ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনেকে আজ সকালে গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়। ছবি: সংগৃহীত

সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে অপহরণ করে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। 

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে র‍্যাবের মধ্যস্থতায় তাকে উদ্ধার করা হয়।

পরে তাকে বান্দরবান সদরে র‍্যাব কার্যালয়ে নেওয়া হয় এবং রাতে তিনি সেখানেই অবস্থান করেন।

আজ শুক্রবার সকালে নেজাম উদ্দীনকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে র‍্যাব।

র‍্যাব জানায়, মঙ্গলবার রাত সোয়া ৮টার দিকে শতাধিক সশস্ত্র কুকি-চীন সদস্য (কেএনএফ) রুমা বাজারে সোনালী ব্যাংকে বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ নিয়ে অতর্কিত হামলা করে।

এ সময় তারা অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্যান্যদের জিম্মি করে ২টি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি, ৮টি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি এবং আনসার সদস্যদের ৪টি শটগান ও ৩৫ রাউন্ড কার্তুজ ছিনিয়ে নেয়।

সন্ত্রাসীরা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা এবং ব্যাংক ম্যানেজার মো. নেজাম উদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। 

শুক্রবার বান্দরবান জেলা পরিষদ হলরুমে সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মইন জানান, সোনালী ব্যাংকে সন্ত্রাসীদের হামলা ও অপহরণের পর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন ব্যাংক ম্যানেজার মো. নেজাম উদ্দীন।

নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি প্রথমে নিজেকে কৃষি অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের সন্দেহ হলে তারা তাকেসহ আরও তিনজনকে ব্যাংকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি রুমের মধ্যে আটকে রাখে।

র‍্যাব জানায়, ম্যানেজারের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জানতে চায়, ব্যাংকে কত টাকা আছে এবং ভল্টে মোট কত টাকা রক্ষিত আছে। তারা ম্যানেজারের কাছে ব্যাংকের ভল্টের চাবি চায়। 

ম্যানেজার নেজাম চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানালে, সন্ত্রাসীরা ভল্ট ভাঙতে চেষ্টা করে। ম্যানেজার তাদের জানায়, ভল্টে আঘাত করলে সেন্সরের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বিষয়টি সোনালী ব্যাংকের হেড অফিস জেনে যাবে। 

তখন তারা ম্যানেজার নেজাম উদ্দীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং পাহাড়ি এলাকায় পৌঁছানোর পর তার চোখ বেঁধে ফেলে।

দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা তাকে পাহাড়ের ঝিরিপথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তার সঙ্গে ১০-১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছিল বলে র‍্যাবকে জানান নেজাম উদ্দীন। 

পথে তারা ম্যানেজারের চোখ খুলে দেয় এবং অন্ধকারে চলার সুবিধার্থে ম্যানেজারকে একটি বাটন ফোন দেয়। মাঝে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেয়, এরপর আবার হাঁটায়।

এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে নেজাম উদ্দীনকে নীরব স্থানে নিয়ে গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ দেয় এবং তিনি যেন পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য তারা পাহারা দেয়।

পরদিন বুধবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ব্যাংক ম্যানেজারকে তারা নাস্তা খাইয়ে আবারও হাঁটিয়ে পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে অন্য একটি পাহাড়ে নিয়ে যায়। 

সেখানে প্রায় ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী অবস্থান করছিল বলে জানান ম্যানেজার নেজাম। 

সেখানে তারা কলার পাতায় তাকে ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খেতে দেয় এবং পরে সেখান থেকে হাঁটিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে নেজামকে ১৫-২০ মিনিটের মতো বিশ্রামের সুযোগ দেয়। 

পরে কয়েক ধাপে তাকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে অন্য একটি জায়গায় নেওয়া হয় এবং রাতের খাবার খেতে দেওয়া হয়। 

র‍্যাব জানায়, সন্ত্রাসীরা সবসময় নিজেদের মধ্যে বম ভাষায় কথা বললেও ম্যানেজারের সঙ্গে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলেছে। সবসময় তাকে ২-৩ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘিরে রাখত এবং ১২-১৩ জন আশপাশে অবস্থান করত। 

বুধবার রাত ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে একটি টং ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে রাতে ঘুমানোর জায়গা দেয়। সেখানে তার সঙ্গে পাহারারত ৫ সন্ত্রাসী ছিল।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত তারা ম্যানেজারকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করে। পরে প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। 

সেখানে ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পর ব্যাংক ম্যানেজারকে মোটরসাইকেলে নতুন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে র‍্যাব জানায়।

র‍্যাব আরও জানায়, অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা ম্যানেজার নেজামকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেয় এবং তিনি যেন প্রশাসনিক বা আইনি সহায়তা না নেন, সে বিষয়ে পরিবারকে সতর্ক করা হয়।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ায় ওই সূত্র ধরে র‍্যাব তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ম্যানেজারের অবস্থান শনাক্ত করে এবং বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের রুমা বাজার ও বেথেলপাড়ার মাঝামাঝি স্থান থেকে নেজাম উদ্দীনকে উদ্ধার করে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt officials, law enforcers involved

Finds probe body; ACC preliminary report names 42 perpetrators

54m ago