কাশ্মীরে যা দেখেছি

কাশ্মীর ভ্রমণ
ছবি: সোমেশ্বর অলি

আমরা যখন কাশ্মীরে স্নো-ফলে ভিজছি, ছবি তুলছি, ভিডিও করছি, ঘুরছি সমুদ্রপৃষ্ট হতে ১৫ হাজার ফুট উপরে বরফ আচ্ছাদিত কোনো মেঘরাজ্যে অথবা থার্মাল-মাফলার-হ্যান্ড গ্লাভস-মোজা পরে 'ইলেকট্রিক ব্লাঙ্কেটে' শুয়ে আছি, সেই এপ্রিলে  দেশে চলছিল 'হিট এলার্ট'!

কবিতা, গল্প বা উপন্যাস পড়ে বাল্যকালে কাশ্মীর-প্রীতি তৈরি হয়েছিল। বলিউডের সিনেমা ও গানে দেখা কাশ্মীর আরও একটু জীবন্ত, পরে তা অনেকখানি রোমান্টিক হয়েও ধরা দিলো। চর্মচক্ষে না দেখেও জেগেছিল বিস্ময়, 'কাশ্মীর এত সুন্দর কেন!'

আমার কাশ্মীর দেখার চোখ তৈরি করে দিয়েছে আমার 'পার্টনার ইন ক্রাইম' তথা সহধর্মিনী নুসরাত জাহান আইভি। এই ভ্রমণগল্পে ওকে বাদামি নামে ডাকব। এটাও ওর নাম, আছে পরিচিতিও। কাশ্মীর বিষয়ক অনেক গল্প শুনেছি ওর কাছে। কোনো একটা জায়গায় না গিয়েও তা সম্পর্কে প্রায়-সম্মক জ্ঞান অর্জন করা কঠিনতম কাজ। দূরবর্তী কাশ্মীর যেন বাদামির নখদর্পণে! ভ্রমণপিপাসু হিসেবে বাদামির কাশ্মীর যাওয়ার 'সুযোগ' একটু দেরিতেই এল, আফসোস। তারপরও পৃথিবীর স্বর্গখ্যাত কাশ্মীর-দর্শন ওর জন্য বিশেষ পাওনা হয়েই থাকবে। একইভাবে আমারও। ওর চোখে তৃপ্তির ছায়া দেখলে আমার ভ্রমণক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

দূরত্ব বিবেচনায় ঢাকা থেকে কাশ্মীর দীর্ঘ পথের যাত্রা। আসা-যাওয়ার পথ অনেকখানি সংক্ষিপ্ত করে দিতে পারে এরোপ্লেন। এর মানে খরচ বেড়ে যাওয়া। আমরা ঢাকা-শ্রীনগর উড়োপথে ট্রানজিট (যাত্রা বিরতি) হিসেবে বেছে নিই দিল্লি। পুরো কাশ্মীর এক্সপ্লোর করার জন্য ৬-৭ দিন প্রয়োজন। আমরা এর সঙ্গে দিল্লি ও আগ্রাকে যুক্ত করে ১২ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করি।

কাশ্মীরে আমরা কী দেখেছি?

শ্রীনগরে অবতরণের আগে থেকেই বিমানের জানালা দিয়ে কাশ্মীর আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। অবারিত মেঘ, পর্বতের ওপর সূর্যালোক, পাহাড়ের খাদে ছোট ছোট ঘরবাড়ি, জমিতে হলুদ সরিষা ক্ষেত, পাইনসহ বিচিত্র বৃক্ষরাজি- এসব দেখতে দেখতে রানওয়ে স্পর্শ করা। সে এক দারুণ মুহূর্ত, স্বর্গীয়। একটা দারুণ সপ্তাহ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বিমান অবতরণের আগেই ঘোষণা এল, শ্রীনগর এয়ারপোর্টে কোনো রকম ছবি তোলা কিংবা ভিডিও করা যাবে না। কিছুটা আতঙ্ক বোধ হল। তবে তা কেটে যেতে সময় লাগেনি।

ছবি: সোমেশ্বর অলি

১২-১৮ এপ্রিল ছিল আমাদের কাশ্মীর দর্শনকাল। এই সাতদিন আমাদের দেখভাল করেছে একটি ট্যুর গ্রুপ, হেভেন ট্যুরিজম। সার্বক্ষণিক একটা প্রাইভেটকার, সঙ্গে গাইড কাম ড্রাইভার। সাতদিনে মোট পাঁচটি হোটেলে ছিলাম আমরা। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, সাইট সিইং- সবকিছুর দায়িত্ব ছিল ওদের ওপর।

সোনামার্গে সেখানকার ডিভাইন ইন হোটেল ও এর অবস্থান, পাহাড়ঘেরা চারপাশের দৃশ্য আমাদের মন কেড়ে নেয়। এই হোটেলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় স্নো ফল শুরু হয়। বলা বাহুল্য যে, খাবার রেখে আমরা চলে যাই স্নো ফল উপভোগ করতে। সে এক অভুতপূর্ব দৃশ্য। বাদামি বা আমি, এর আগে কেউই বরফবৃষ্টি ছুঁয়ে দেখার বা গায়ে-মুখে মাখার সুযোগ পাইনি।

রোড টু টিউলিপ গার্ডেন। ভেতরে ঢোকার আগে প্রচুর গাড়ি ও দর্শনার্থী। সঙ্গে বৃষ্টি। বছরে মাত্র কয়েকদিনের জন্য এই বাগানের গেট খুলে দেওয়া হয়, যখন ফুল ফোটে। আমরা সৌভাগ্যবান। ফুল বলতে অজ্ঞান বাদামি। একসঙ্গে এত টিউলিপ দেখা ওর জন্য এক বিরল অভিজ্ঞতা। ফুলের সঙ্গে মিলিয়ে পোশাক পরেছিল বাদামি। আমি সেখানে বেমানান।

পরের গন্তব্য হাউজ বোট, ডাল লেক, শ্রীনগর। সকাল থেকে সঙ্গী বৃষ্টি। ডাল লেকের পাশে মূল সড়ক ধরে ১৪ নম্বর ঘাট থেকে হাউজবোটে প্রবেশ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বেরসিক বৃষ্টিতে অর্ধেক জিনিসপত্র ভিজে একাকার। হাউজবোটে আলো ছিল না বললেই চলে। সে আলোর দেখা আমরা পাইনি পরদিন সকাল পর্যন্ত। বোটের সম্মুখভাগে বসে বৃষ্টি দেখে দেখে রাত নামল। একটি সুনসান রাত, জল-পাহাড়ের মেলবন্ধন, অপার্থিব কিছু দৃশ্য, সিকারা রাইড, এক বুক স্মৃতি, তীব্র শীতল হাওয়া- আহা ডাল লেক, ভুলব না!

কাশ্মীর
ছবি: সোমেশ্বর অলি

ডাল লেক থেকে পেহেলগাম যাওয়ার সময় পথের ধারে চোখে পড়বে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট ফ্যাক্টরি। ছাদে, দোকানে, রাস্তায় থরে থরে সাজানো ক্রিকেট ব্যাট। এই পথে আপেল বাগানে আমরা সময় কাটিয়েছি। গাছে আপেল নয়, ফুল পেয়েছি। যথারীতি ফুল বলতে অজ্ঞান বাদামি ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বিকেলের পেহেলগাম বাজার আমাদের স্মৃতিতে রয়ে যাবে অনেক দিন। এখানকার প্যারাডাইস হোটেলে আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি, দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুখে লেগে থাকবে সেই খাবারের স্বাদ। কাশ্মীরিদের নিজস্ব রেসিপির এই খাবরের নাম ওয়াজওয়ান। খাসির মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আইটেম, সঙ্গে বিরিয়ানি। বাদামির আফসোস, এই খাবার কেন সে আরও দুয়েকদিন খাওয়ার সুযোগ নেয়নি!

গুলমার্গের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটি আফারওয়াত পিক। এর ফেজ ১ ও ফেজ ২-এ পৌঁছাতে এবং সেখান থেকে ফেরত আসার একমাত্র বাহন ক্যাবল কার (গন্ডোলা)। সেই ক্যাবল কারে চড়তে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করা লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বড় ক্লান্তিকর সেই অপেক্ষা, কিছুটা অমানবিকও। প্রকৃত ভ্রমণপিপাসু ছাড়া এই ত্যাগ স্বীকার করা অসম্ভব ব্যাপার। আমরা তা জয় করতে পেরেছি। বাদামি দ্বিতীয় ফেজে শাড়ি পরেছিল। সাদা বরফের মধ্যে লাল শাড়ি। এ ছাড়া আরও তিনটি স্থানে সে শাড়িতে সেজেছিল। 'তুম ক্যা মিলে' গানের আলিয়া ভাটের শাড়ির সঙ্গে মিল ছিল দুটি শাড়ির। ভাবা যায়!

 

Comments

The Daily Star  | English
Unhealthy election controversy must be resolved

Unhealthy election controversy must be resolved

Just as the fundamental reforms are necessary for the country, so is an elected government.

4h ago