নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুললেন ঢাকার জুবায়ের

ছবি কার্টেসি: জুবায়ের কাওলিন

ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে নিজেই তৈরি করেছেন। তার ছবিতে নীহারিকার উজ্জ্বল তারকারাজি, ধূলিমেঘ ও গ্যাসীয় ধূলিকণা উঠে এসেছে।

পৃথিবী থেকে প্রায় এক হাজার ৩৫০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কালপুরুষ নীহারিকাকে বলা হয় নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর (ইংরেজিতে 'স্টেলার নার্সারি')। কারণ মহাকাশের এ অঞ্চলে নিয়মিত জন্ম নেয় নতুন নতুন নক্ষত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি গবেষণা হওয়া অঞ্চলগুলোর একটি এটি। এই নীহারিকার আরেক নাম মেসিয়ার ৪২। নক্ষত্র গঠনের অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত এই নীহারিকা পেশাদার, অপেশাদার দুই ধরনের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফারদের কাছেই ব্যাপক জনপ্রিয়। এই নীহারিকার পরিষ্কার ছবি এবং সেটি তুলতে ব্যবহার করা স্বনির্মিত টেলিস্কোপের জন্য দেশে ভালোই মনোযোগ আকর্ষণ করছেন জুবায়ের।

জুবায়েরের তোলা কালপুরুষ নীহারিকা।

জুবায়েরের ছবিতে নীহারিকার ভেতরের দৃশ্য উঠে এসেছে, যেখানে নতুন তারার জন্ম হচ্ছে। এসব তারার আশেপাশে থাকা গ্যাস ও ধূলিকণাও উঠে এসেছে ছবিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ছবি ছড়িয়ে পড়লে আমরা জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুনি তার গল্প।

টেলিস্কোপ নির্মাণ: সম্পদ সীমিত, উদ্ভাবনই ভরসা

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে প্রকৌশল ও নকশায় নিজের দক্ষতা ব্যবহার করে, হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন উপকরণ ব্যবহার করে এই  টেলিস্কোপ তৈরি করেন জুবায়ের। স্থানীয় একটি হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে কেনা চার ও পাঁচ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের পিভিসি পাইপ দিয়ে টেলিস্কোপের প্রাথমিক টিউবটি বানান। এরপর বিভিন্ন অনলাইন স্টোর থেকে সাহায্য নিয়ে তার ১০২ মিলিমিটার অ্যাপারচার অবজেক্টিভ লেন্স তৈরি করেন। স্থানীয় বাজার থেকে কেনা একটি থ্রিডি প্রিন্টার ব্যবহার করেও টেলিস্কোপের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন।

জুবায়েরের টেলিস্কোপের ৩ডি ছবি।

আজীবনের স্বপ্ন

জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি জুবায়েরের আগ্রহের শুরু অল্প বয়সেই। শিশুদের বিজ্ঞান বই থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ১২ বছর বয়সেই কার্ডবোর্ডের টিউব ও চশমার লেন্স দিয়ে প্রথম টেলিস্কোপ তৈরি করেছিলেন তিনি। সেটি দিয়ে প্লেইয়েডস স্টার ক্লাস্টারের দিকে তাক করেছিলেন। সেদিন হঠাৎ করে হাজার হাজার তারা দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তার ব্যক্তিত্বের ওপর একটি স্থায়ী ছাপ ফেলে। একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি করার স্বপ্ন তখন থেকেই দেখতে শুরু করেছিলেন। তবে বড় হওয়ার পর থ্রিডি অ্যানিমেশন এবং ভিজ্যুয়াল ইফেক্টকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন জুবায়ের। এই পেশা তার সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ালেও এর বাইরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পেছনে তেমন সময় দিতে পারছিলেন না।

২০১৮ সালে ইলেকট্রনিক্স, রোবোটিক্স এবং থ্রিডি প্রিন্টিং নিয়ে গবেষণা করার সময় জুবায়েরের আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জেগে ওঠে। তখন তিনি ভাবতে শুরু করেন, এই খাত থেকে পাওয়া দক্ষতা দিয়ে হয়তো একটি কার্যকরী টেলিস্কোপ তৈরি করতে পারবেন, যা তার ছোটবেলার স্বপ্ন।

১২ বছর বয়সে বানানো প্রথম টেলিস্কোপ।

কয়েক মাস গবেষণার পর, ২০১৯ সালে প্রথম অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি করার চেষ্টা করেন তিনি। বাড়ির ছাদে উঠে একটি সাধারণ ক্যামেরা এবং ট্রাইপড ব্যবহার করে দূর-আকাশের ছবি তোলেন। সেই ছবিগুলো প্রক্রিয়াজাত করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, এতে খুবই ক্ষীণ পরিসরে নীহারিকার আলো দেখা যাচ্ছে। সেটি দেখে সিদ্ধান্ত নেন, ভালো মানের একটি টেলিস্কোপ তৈরি করতে হবে, যাতে দূরের আকাশের ভালো মানের ছবি তুলতে পারেন।

প্রযুক্তি ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে রাতের আকাশ ধারণ করার চেষ্টা

যখন সিদ্ধান্ত নেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি করবেনই, তখন কম দামে আরেকজনের ব্যবহৃত একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা কেনেন জুবায়ের। সেই ক্যামেরায় কিছু পরিবর্তন এনে অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলেন। তবে সেটি আকাশের দিকে তাক করার পর অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হয় তার। সঙ্গে ঢাকার উষ্ণ জলবায়ু এবং তীব্র আলো দূষণ তো আছেই।

এসব সমস্যা সমাধান করতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কিউএইচওয়াই ২৬৮সি নামে একটি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি ক্যামেরাই কেনেন জুবায়ের। এই ক্যামেরার মাধ্যমে ইমেজ সেন্সরে সাব-জিরো তাপমাত্রা বজায় রাখতে সক্ষম হন তিনি, যার ফলে ছবির মানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। তবে এই পদ্ধতিতে নীহারিকার ছবি তোলা সহজ হলেও শহরের আলোক দূষণের মধ্যে বড় পরিসরে ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির ছবি তোলা কঠিন হয়ে যায়।

জুবায়েরের তোলা নীহারিকা।

দূর-আকাশের ছবি তোলার পাশাপাশি জুবায়েরের এই টেলিস্কোপ চাঁদ ও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের ভালো ছবি তুলতে সক্ষম হন। বহুমুখী ছবি তোলায় দক্ষ এবং স্থায়ীত্বের জন্য ডিজাইন করা তার সরঞ্জামগুলো দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে। এই টেলিস্কোপের ডিজাইন এমনভাবে করেছেন তিনি, যাতে করে এটি যে কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারেন এবং কেবল ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই ব্যবহার করতে পারেন।

ভবিষ্যৎ চিন্তা

জুবায়েরের জন্য অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি কেবল শখ না। এটি তার মহাবিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং এর মধ্যে আমাদের অবস্থান খোঁজার উপায়। রাতের আকাশের ছবি তোলার মধ্যে তিনি গভীর আনন্দ এবং জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পান। তার মতে, এটি তাকে প্রাণের উৎস এবং বিস্তৃত মহাবিশ্বের কাছাকাছি নিয়ে যায়।

'এই টেলিস্কোপ তৈরি করাটা একটি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ ছিল, যেটা আমি বেশ উপভোগ করেছি। আরও বড় এবং ভালো মানের যন্ত্র তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাব আমি,' বলেন জুবায়ের।

তিনি আরও বলেন, 'আমার লক্ষ্য হচ্ছে, মহাবিশ্বের আরও বিস্ময়কর ছবি তোলা এবং অন্যদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলা। হয়তো আমি একটি শিশুকে অনুপ্রাণিত করব, যে একদিন অন্য এক গ্রহে পা রাখবে।'

জুবায়েরের তোলা নীহারিকা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ব্যক্তিগত প্রচারের মাধ্যমে জুবায়ের অন্যান্য উঠতি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফারদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এভাবে দেশে অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফারদের একটি গোষ্ঠী তৈরি করতে চাইছেন তিনি, যারা জ্ঞান ও সম্পদে উন্নত বিশ্ব থেকে পিছিয়ে আছে।

জুবায়ের রাতের আকাশ অন্ধকার রাখার পক্ষে। তার মতে, কেবল অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফির জন্যই নয়, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশগত কারণে কৃত্রিম আলোর দূষণ কমানো উচিত।

অনুবাদ করেছেন কিরো আদনান আহমেদ

Comments

The Daily Star  | English

Stocks fall on poor performance of large companies

Indexes of the stock market in Bangladesh declined yesterday on rising the day before, largely due to the poor performance of Islami Bank Bangladesh along with the large-cap and blue-chip shares amid sales pressures..Large-cap refers to shares which account for large amounts in market capi

2h ago