ভয়মুক্ত হোক বইমেলা

প্রকাশনা সংস্থা সব্যসাচীর স্টলের পাশেই ১২৬-১২৭ ইউনিট নিয়ে পলল প্রকাশনীর স্টল। সেখান থেকে আমার একটা গ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার কথা। সেই গ্রন্থের কাভারের কপি আনতে ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গিয়েছিলাম। তসলিমা নাসরিনের গ্রন্থ নিয়ে ন্যাক্কারজনক, নজিরবিহীন ঘটনাটি আমার চোখের সামনেই ঘটেছে।

কী ভয়াবহ! একদল মানুষ এসে স্রেফ গুণ্ডামি করে একজন লেখকের বই বিক্রি বন্ধ করে দিল। ত্রাস তৈরি করে একটি স্টল বন্ধ করে দিল। বিশ্বাস করুন, রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ঘটনা যখন দেখছিলাম তখন ভয়ে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। এরমধ্যে এক জায়গায় স্বস্তি, সব্যসাচীর প্রকাশক শারীরিকভাবে আক্রান্ত হননি। তবে তিনি যে মবের মধ্যে দিয়ে গেছেন তা তার সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

এ ঘটনার পর আধা ঘণ্টা মেলায় ছিলাম। পুরো সময়টাতে আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম—এই বাংলাদেশ পেতেই কি জুলাই-আগস্টে এত প্রাণ বিসর্জন? কে ধ্বংস করছে অভ্যুত্থানের এই অমূল্য ফসল? কে প্রতিষ্ঠা করছে ভারতীয় বয়ান? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরেছি।

তসলিমা নাসরিনের অনেক লেখা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিভিন্ন বিষয় অবতারণার ক্ষেত্রে তিনি আক্রমণাত্মক সেটাও সত্য। কিন্তু তিনি একজন লেখক। তার চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। প্রকাশকের তার বই প্রকাশের স্বাধীনতাও আছে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের স্বীকৃতি। ভয় দেখিয়ে, মব তৈরি করে এটা বন্ধ করা অপরাধ।

কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় গোপন কোনো কারণে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ এখনও নিদারূণভাবে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণির উন্মত্ত জনতা মাজার ভাঙছে, আখড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে, দরগা গুড়িয়ে দিচ্ছে আর সবাই চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আর আমাদের উপদেষ্টারা অনেক কষ্ট করে সুললিত ভাষায় জারি করছেন বিবৃতি। এটাই মনে হয় অক্ষমের আস্ফালন শব্দের নিখুঁত মঞ্চায়ন।

ভয় দেখিয়ে স্টল বন্ধ করার পরও আমরা সেই হুমকি দেখলাম। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম হুংকার ছেড়েছেন, 'আপনাদের ডেভিল (শয়তান) হিসাবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে। ...জুলুম থেকে বিরত থাকেন, নইলে আপনাদের উপর জুলুম অবধারিত হবে।' এর আগেও সরকারের তরফ থেকে বিবৃতি এসেছে। সেখানেই শেষ। দেখুন এই বিশৃঙ্খলা আর নিরাপত্তাহীনতায় মানুষ ক্রমাগত অনিরাপদ বোধ করছেন। আপনাদের নিষ্ক্রিয়তায় তিতিবিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে। এগুলো আমলে নেন। দ্রুত ব্যবস্থা নেন। সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে।

আরেকটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের পর থেকেই আমাদের আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছে। চলছে অপতথ্যের সমন্বিত প্রচারণা, সংবাদের নামে সার্কাসের প্রদর্শনী। কিন্তু এর বিপরীতে বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার মাজার ভাঙা থামাতে পারেনি, মেয়েদের ফুটবল খেলায় বাঁধা কাটাতে পারেনি, সংস্কৃতি চর্চার মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। এগুলো বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা মানুষ বেশি দিন সহ্য করবে না।

আর মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান ইন্টারনেট যুগে এই ঘটনাগুলো চাপা দেওয়া অসম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিবের বাগাড়ম্বর আর সরকারের ৯০ ভাগ সফল হওয়ার দাবিকে জনগণ উপহাস করবে। সম্ভবত সেই উপহাস শুরু হয়েও গেছে।

উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এই ঘটনা ঘটার পরপরই ফেসবুকে কড়া বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের পর দেখলাম এরপরও বাংলা একাডেমিতে স্থাপিত পুলিশ বক্স থেকে অপরাধীর মতো হেলমেট পড়িয়ে, বুলেট প্রুফ জ্যাকেটে জড়িয়ে প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বের করে আনতে হচ্ছে। আর উশৃঙ্খল মব সেখানেও হামলে পড়ছে তীব্র জিঘাংসায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উপদেষ্টার হুংকার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখলাম। কী নিদারুণ নিষ্ক্রিয়তা।

মোদ্দা কথা, দেশ এভাবে চলতে পারে না, এই ভয়ের সংস্কৃতি অবসান করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনাদের ব্যর্থতা অন্যকিছুর পথ খুলে দেবে। যা সহ্য করা বা সামলানো সহজ নাও হতে পারে। মিনতি রইল, জাতিকে সেই পথে নেবেন না।

 

রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

Promises vs reality: RU students still face poor food, housing woes

RU has around 32,000 students but its 17 residential halls can house only about 10,000

1h ago