পোশাক-জুতা কারখানার শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে মুদি দোকান

পোশাক শ্রমিক জেসমিন আক্তার তার কারখানার সুপার শপ থেকে ২৫ কেজির চালের বস্তা নিয়ে বের হলেন। এর জন্য কোনো নগদ টাকা দিতে হয়নি। শুধু তার অফিস থেকে দেওয়া ছোট নম্বরের টোকেন দেখাতে হয়েছিল।
ক্যাশিয়ার মাথা নেড়ে টোকেনের নম্বরগুলো টুকে নেন। মাস শেষে সেই শ্রমিকের মজুরি থেকে টাকা কেটে নেওয়া হবে। কোনো বাড়তি খরচ দিতে হবে না।
গাজীপুরে ঊর্মি গার্মেন্টসের দোকান থেকে চাল-ডাল, তেল, চিনি, চা-কফিসহ নিত্যপণ্য কেনা যায়।
কারখানার পক্ষ থেকে দোকানের ইউটিলিটি বিল ও পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া হয় বলে জেসমিন আক্তারের প্রতি মাসের বাজার খরচ অন্তত এক হাজার টাকা কমেছে। পরিমাণে এই টাকা অনেকের কাছে কম মনে হতে পারে কিন্তু তা জেসমিনকে অনেক স্বস্তি দেয়। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে হওয়ায় জেসমিনের কাছে ন্যায্যমূল্যের এই দোকান-ব্যবস্থা ব্যতিক্রম বটে।
সিনিয়র কোয়ালিটি ইনসপেক্টর জেসমিন আক্তারের কাছে এটি আরও বেশি কিছু—বাজারের ভিড় এড়ানো যায়। ঘরে খাবার না থাকলে কারখানার দোকান থেকে সহজেই পণ্য কেনা যায়।
কিন্তু, এমন ব্যবস্থা করে কারখানার লাভ কী? একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য যখন থাকে মুনাফা বাড়ানো তখন তারা মুদির দোকান খুললেন কেন?
২০০৮ সালে প্রথম এই ব্যবস্থা চালু হলে নাম দেওয়া হয় 'ন্যায্যমূল্যের দোকান'। কয়েকটি শিল্পাঞ্চলের পোশাক ও জুতা কারখানায় এখন এমন ২৫০ দোকান আছে। গত পাঁচ বছর আগে ছিল অনেক কম।
এসব দোকান শ্রমিকদের খাবারের খরচ কমাতে সহায়তা করছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসা পেয়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতাদের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ভর্তুকি দাম দেওয়ায় সেখান থেকে নিত্যপণ্য কেনার বিষয়ে শ্রমিকদের আগ্রহ আরও বেড়েছে।

কারখানার দুর্ঘটনা থেকে শ্রমিক কল্যাণ
প্রায় ১৭ বছর ধরে শিল্পাঞ্চলগুলোয় ন্যায্যমূল্যের দোকান চলছে।
২০০৮ সালে দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক কারখানা ডিবিএল গ্রুপ নিত্যপণ্যের দোকান খুললে তা বেশ আলোচনায় আসে।
ডিবিএল গ্রুপের চিফ সাসটেইনেবিলিটি অফিসার মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুরুতেই বুঝতে পেরেছি যে শ্রমিক কল্যাণ পণ্য উৎপাদনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।'
তার প্রতিষ্ঠানে একসময় যা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল আজ সেখানে নয়টি দোকান হয়েছে। কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক এই সুবিধা পাচ্ছেন।
দেশে শিল্পকারখানায় দুটি বড় দুর্ঘটনার পর এই উদ্যোগ গতি পেয়েছে। পোশাক খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও পরের বছর রানা প্লাজা ধসে এক সঙ্গে বহু শ্রমিক নিহত হন। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা নিয়ে কারখানা মালিকরা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন।
এই দুর্ঘটনাগুলো শুধু যে দেশে শ্রমিক কল্যাণ ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে তা নয়, দেশের তৈরিপোশাক রপ্তানিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলে কারখানায় সংস্কার দ্রুত করতে হয়।
এর ফলে কারখানা মালিকরা সবাই মিলে শ্রমিকদের কল্যাণে বিষয়টি অনুভব করেন। এর মধ্যে আছে ন্যায্যমূল্যের দোকান।
করোনা মহামারির লকডাউনের সময় যখন বাজারে যাওয়া ঝামেলার ছিল তখন এই দোকানগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায়।
মোহাম্মদ জাহিদুল্লাহ সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'যখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, চলাচলে বিধিনিষেধ আসে ও কেনাকাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন আমাদের ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো শ্রমিকদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।'
এই ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত প্রশংসা পেয়েছে।
তার মতে, 'বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো এখন এসব উদ্যোগকে নৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখছে।'
এই ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলো কারখানার মুনাফার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। পরিচালন খরচসহ কারখানাগুলো স্থানীয় বাজারের তুলনায় ১০ শতাংশ কম দামে নিত্যপণ্য বিক্রি করছে।
২০০৮ সালে শ্রমিকদের জন্য এই কল্যাণ প্রকল্প বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হলেও তা ধীরে ধীরে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। দোকানগুলোয় অনেকের কাজের সুযোগ হয়েছে। লাখ লাখ টাকার পণ্য কেনাবেচার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে গতিশীল করেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো শ্রমিকের কল্যাণে এসব ব্যবস্থা পোশাক রপ্তানি বাড়াতে অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্ববাজারে মোট বিক্রি হওয়া পোশাকের প্রায় আট শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আছে।

ভর্তুকির হিসাব-নিকাশ
এসব ন্যায্যমূল্যের দোকানের প্রভাব বুঝতে জেসমিন আক্তারের চাল কেনার ঘটনাটিকে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
তার কারখানার ন্যায্যমূল্যের দোকানে ২৫ কেজির চালের বস্তা কিনতে খরচ হয় এক হাজার ৮৫০ টাকা। স্থানীয় বাজারে এর দাম এক হাজার ৯৫০ টাকা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এই ছাড় তার পরিবারকে আর্থিক স্বস্তি দিয়েছে। জেসমিন বলেন, 'আমার প্রায় সব পণ্যে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ খরচ বেঁচে যায়।'
বেঁচে যাওয়া টাকা তিনি পরিবারের উন্নয়নে খরচ করতে পারেন।
জেসমিন আক্তারের ঊর্মি গার্মেন্টসের ন্যায্যমূল্যের দোকান আলাদা কর্মীদের মাধ্যমে চালানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কেনা দামে পণ্য বিক্রি করি। ভর্তুকি দিই এক শতাংশ।'
তার কারখানার দোকানটি প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিকের কাছে পণ্য বিক্রি করে। কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা হয়। দোকানে কম দামে পাঁচ শর বেশি পণ্য বিক্রি করা হয়।
এই ব্যবস্থার সাফল্য দেখে বিদেশিরা সেসব কারখানা থেকে পোশাক কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এখন আরও কারখানায় এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।
ন্যায্যমূল্যের চেইন শপ 'আমার দোকান'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর সিফাত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শ্রমিক আগে নিত্যপণ্য কিনতে টাকা ধার করতেন তাদেরকে বছরে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হতো। আমাদের দোকান থেকে কেনাকাটা করায় তাদেরকে আর ঋণ করতে হচ্ছে না। উল্টো আট থেকে ১০ শতাংশ টাকা বাঁচাতে পারছেন।'
বর্তমানে ১২ পোশাক ও জুতা কারখানার ৮০ হাজার শ্রমিকে সেবা দিচ্ছেন সিফাত।
এসব দোকানে এখন নিত্যপণ্যের বাইরে বিলাসী পণ্যও বিক্রি হচ্ছে।
ঊর্মি গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ আরও বলেন, 'এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ও কফির মতো পণ্য বিক্রি করছি। আমাদের অনেক কর্মী এগুলো কিনছেন।'

শ্রমিকের মনে সেবার প্রভাব
বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগে অংশ নেওয়ায় ন্যায্যমূল্যের দোকানের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
চট্টগ্রামে কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের ইয়াংওয়ান গ্রুপের কেএসআই গার্মেন্টসের প্রায় ৩০ হাজার কর্মী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ পরিচালিত দোকান থেকে উপকৃত হচ্ছেন।
কেএসআইয়ের প্রশাসন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ শামসুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রাণ-আরএফএল সাশ্রয়ী দামে পণ্য দিচ্ছে। আমরা ইউটিলিটি খরচ দিচ্ছি। সবাই মিলে শ্রমিকদের কাছে সাশ্রয়ী দামে মানসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছি।'
শ্রমিকের মনে সেবার প্রভাব অনেক আর্থিক সুবিধার চেয়েও বেশি।
গাজীপুরে ১২ হাজার শ্রমিকের দোকান পরিচালনাকারী উটাহ গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টার বলেন, 'শ্রমিকরা যখন মনে করেন তাদের মালিকরা সত্যিই যত্নশীল, তখন নিঃসন্দেহে তারা আনন্দিত হন।'
পাঁচ বছর আগে মাত্র কয়েকটি দোকান ছিল। এখন পোশাক ও চামড়া শিল্পের প্রায় ২৫০টি দোকান হয়েছে। দোকানের সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির তিনটি কারখানায় ন্যায্যমূল্যের দোকান চালান। দলনেতা আব্দুল্লাহ হিল রাকিব ডেইলি স্টারকে জানান, তার ২৩ হাজার শ্রমিকের সবাই প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার টাকা করে সাশ্রয় করতে পারেন।
'সঞ্চয়ের পাশাপাশি কর্মীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা শেখাচ্ছি' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'শ্রমিকরা যাতে তাদের ঋণ পরিশোধ করেও সুন্দরভাবে সংসার চালাতে পারেন সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।'

বেসরকারি উদ্যোগ সরকারকেও সহযোগিতা করে
যদিও বেসরকারি খাত ন্যায্যমূল্যের দোকান চালিয়ে সাফল্য পেয়েছে তবুও শ্রমিকরা এই ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক করতে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দোকানগুলো ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করলেও শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি রেশন কার্ড প্রয়োজন।'
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেশন চালুর জন্য ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যদিও বাস্তবায়নে প্রচুর টাকার দরকার।'
Comments