আধুনিক ফ্যাশনে আদিকালের আলতা: কেমন নকশা, কেমন সাজ

আলতা পরা পায়ে হেঁটে যাছে গ্রামীণ বধূ। আমাদের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন বউ আর আলতার সম্পর্কটা এমনই মিষ্টিমধুর যে কখনোই ভোলা যায় না। তবে বাঙালির ফ্যাশন এখন হাল আমলের সঙ্গ নিয়েছে। বহু পুরোনো বিষয়কে নতুন করে আবিষ্কারের যুগ চলছে। একইসঙ্গে পুরোনো নকশাকে ভালোবেসে বরণ করার প্রথাও বাতিল হয়ে যায়নি।
লাল মানেই ভালোবাসার রং। তাই বিশেষ এক ভালোবাসার রঙে রাঙাতে আলতার জুড়ি নেই। এখন তো বেশ টিউব আলতার ট্রেন্ড হয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই কি ভোলা চলে ছোটবেলায় খেলার ছলে প্রথম বউ সাজার সময় তুলোর মুঠিতে সাজানো সেই আলতার ছোঁয়া? সাজে-পোশাকে বাঙালি সবসময়ই স্মৃতিকাতর। আলতাও সেই স্মৃতিকাতরতার একটি বিশেষ অনুষঙ্গ হয়ে আজও জড়িয়ে আছে আমাদের ফ্যাশনে, সাজের উদযাপনে।
কোথায় পাবেন
গ্রামের সেই লেইসফিতার বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালাদের মনে আছে তো? যাদের জাদুর বাক্সে ধরা থাকতো শৈশবের কত না রং। তাদের সেই কাঁচের ঢাকনাওয়ালা বাক্সের বেসাতিতে আলতাভর্তি কাঁচের শিশি থাকবেই। কেউ যদি একেবারেই পুরোনো ছাঁচের আলতা চান, তবে একটু ঢাকার বাইরের গ্রামের এলাকাগুলো বা সুলতানগঞ্জের দিকে খোঁজ করতে পারেন। পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজার এলাকাতেও সেই আদ্যিকালের আলতা মিলে যেতে পারে। তবে এমনিতে হাতের নাগালে চাইলে ঢাকার নিউমার্কেট, গাউছিয়ার বিভিন্ন কসমেটিকস পণ্যের দোকানে প্লাস্টিক বোতলের প্যাকেজিংয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আলতা। বাংলাদেশের স্থানীয় ব্র্যান্ড মহারাণীর আলতার দাম হাতের নাগালে, প্রতি বোতল আলতার দাম ৫০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। অন্যদিকে আমদানিকৃত আলতার দাম মান ও রঙের গাঢ়তা অনুযায়ী ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে কাবেরী আলতার ভালো চল রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মন্দিরের সামনে যে দোকানগুলো বসে এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনুকরণে যে মেলাগুলো হয়- সেখানেও আলতার খোঁজ পাওয়া যাবে।
কোন সাজের সঙ্গে মানাবে
বিয়ের সাজে কন্যার হাতে, পায়ে আলতার ব্যবহার তো হয়েই থাকে, তবে নববর্ষ-ফাগুন এইসব বাঙালিয়ানা উৎসবে বোনেরা একসঙ্গে বসে পায়ের চারদিকে আলতা মাখাতে বসে যেতে পারেন। দু পায়ে দুগাছি নুপূর, পায়ের চারদিকে আলতার রাঙা সাজ আর একপ্যাঁচে শাড়ি পরলে দারুণ মানাবে। মনে হবে, গল্পের সেই গাঁয়ের বধূ বোধকরি বধূবরণের পরই বেরিয়ে পড়েছে এক নতুন বিশ্বভ্রমণে।
তবে আধুনিক সাজ তো কোনো সীমারেখা মেনে চলে না। পুরোনোর সঙ্গে নতুনের সমন্বয় আর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায় আধুনিক সাজ। তাই কেউ চাইলে নিশ্চয়ই বৈশাখের সাজে লাল-সাদা কুর্তি বা স্কার্টের সঙ্গে হাতে-পায়ে আলতার সাজে হয়ে উঠতে পারেন আরও রঙিন। এছাড়া নৃত্যশিল্পীদের সাজ-পোশাকে আলতার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
আলতার নকশা
আলতার নকশা বড় সহজ-সরল। খুব বেশি জটিল নকশার সুযোগও নেই তাতে, যদি না কেউ বিশেষভাবে তার আবদার করে বসেন। সাধারণ আলতা দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে বড় একটি গোল বৃত্ত আঁকা হয় আর তার চারপাশে ছোট ছোট বিন্দু দেওয়া হয়। আর নয়তো সেই চিরায়ত কল্কির আঁকাবাঁকা চেহারায় আলতা ভেসে ওঠে। এছাড়া তুলি দিয়ে ছবি এঁকেও আলতা দিয়ে পায়ের নুপূর বা হাতের বন্ধনী তৈরি করা যায়। নতুনভাবে আলতাকে আবিষ্কার করতে চাইলে ব্যবহার করা যেতে পারে মেহেদির মতো ডিজাইনের ছাঁচ কিনে।
বর্তমানে আলতার মধ্যে অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হলেও অতীতে তা ছিল একেবারেই প্রাকৃতিক প্রসাধনী। অর্জুন বা পলাশ গাছের মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষত থেকে লাল রস ঝরে পড়ত। সেই লাল রঙা, আঠালো পদার্থটিকে বলা হতো লাক্ষা বা গালা। আর তা দিয়ে বানানো হতো আলতা, লিপস্টিক বা ওষ্ঠরঞ্জনী ইত্যাদি বিভিন্ন সাজার বস্তু।
সময় পাল্টেছে, ফ্যাশন ও সাজ এগিয়ে গেছে বহুদূর। তবে এখনো লাল শাড়ি, কপালে টিপ আর চোখে কাজলের সঙ্গে বাঙালি নারীর সৌন্দর্যে অনন্য মাত্রা যোগ করে আলতা পরা পায়ের ছাপ।
Comments