সবাই কেন উত্তরামুখী হচ্ছে?

'উফফফ, উত্তরা অনেক দূরে! উত্তরায় এত যানজট! উত্তরা তো একটা গ্রাম!'
সেই কবে থেকে যে পরিচিতজনদের কাছে এসব কথা শুনছি আর ক্রমাগ্রত সহ্য করে চলছি। কারণ আমি সবার চোখে 'দূরে' উত্তরা এলাকায় থাকি।
আমার কল্পনায় উত্তরা ম্যালিফিসেন্ট চলচ্চিত্রের বাগানের মতো। এমন একটি জাদুকরি বন, যা মানব সাম্রাজ্যের কিনারে অবস্থিত। বৃহত্তর ঢাকা মহানগরীর মধ্যে উত্তরাকে ধরা হয় মডেল টাউন হিসেবে।
অবশ্য অনেকেই উত্তরাকে এত গুরুত্ব দিতে চান না। তাদের জন্য বলি, ভীষণ পরিকল্পিত এই শহরতলীটি ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি বিভাগ এবং মূল শহরের কেন্দ্রস্থলের তুলনায় অনেক বেশি সবুজ আর গোছানো।
তবে ঢাকার উত্তরাঞ্চলের এই চমৎকার শহরতলীতে বসবাসের বেশকিছু সুবিধা আর অসুবিধা দুটোই রয়েছে এবং আমি এর সঙ্গে একমত। অনেকের জন্যই দূরত্ব একটি বড় সমস্যা। তবে কী জানেন? জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তরার দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। ঢাকার অন্যান্য উপকণ্ঠ এবং আশপাশের এলাকায় যেতে যে পরিমাণ সময় লাগে তার সঙ্গে তুলনা করলে উত্তরা খুব বেশি দূরেও নয়।
উত্তরায় তীব্র যানজটের কারণ টঙ্গী-গাজীপুর মহাসড়ক অথবা ময়মনসিংহ রোডে চলাচলরত যানবাহনের জট। তাছাড়া এই সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকার ভেতরে মাত্র কয়েকটি ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে, যেগুলো যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
দুই দশক ধরে এখানে বসবাসের ফলে আমি এখন বলতে পারি যে, উত্তরা বর্তমানে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের সমৃদ্ধ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। যা কয়েক বছর আগেও ছিল না।
সাধারণ মানুষের চলাচলেল জন্য প্রশস্ত সব রাস্তা আর এভিনিউ রয়েছে এখানে। যেমন রবীন্দ্র সরণি, জসিমউদ্দীন এভিনিউ, সোনারগাঁও জনপথ, গরীব-ই-নেওয়াজ এভিনিউ এবং গাউসুল আজম এভিনিউ। শুরুতে যখন উত্তরা আসি তখন এসব এলাকা একেবারেই নীরব আর ফাঁকা ছিল। সেই তুলনায় এখন রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, রুফটপ রেস্তোরাঁ, শপিং মল, হোটেল আর অফিসে ভরে উঠেছে।
ঢাকার বেশিরভাগ জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ উত্তরায় তাদের শাখা খুলেছে। আর প্রতিদিন অফিসফেরত সন্ধ্যায়, বিকেলে কিংবা ছুটির দিনে এসব রেস্তোরাঁ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। যা উত্তর রাতগুলোকে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত।
উত্তরার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ধারে অবস্থিত ১৩ তলা বিশিষ্ট অভিজাত লিবার্টি টাওয়ারে নর্থ এন্ড কফি রোস্টারের অবস্থান। এছাড়া গরীব-ই-নেওয়াজ এভিনিউয়ের আধুনিক স্থাপত্য নাভানা সেন্ট্রয়েডে আছে গ্লোরিয়া জিন্স। সোনারগাঁও জনপথে রয়েছে হালের জনপ্রিয় বোবা চায়ের দোকান কই তে বাংলাদেশ। এসবগুলোই তরুণদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সময় কাটানোর চমৎকার স্থান।
অন্যান্য সাধারণ রেস্তোরাঁর পাশাপাশি উত্তরার অনন্য দুটি খাবারের জায়গা হলো গাউসুল আজম এভিনিউয়ের ইয়ামা হটপট অ্যান্ড গ্রিল এবং হুয়াক্সিং চাইনিজ ফুড। সম্ভবত ঢাকায় এ ধরনের খাবারের দোকানের মধ্যে এ দুটোই প্রথম। হুয়াক্সিংয়ে মেলে একেবারে অথেনটিক চাইনিজ খাবার। এ দুটি রেস্তোরাঁ যে খুব অভিনব বা আধুনিক পরিবেশের তা নয়, বরং নির্ভেজাল স্বাদ আর সাশ্রয়ী দামের জন্যই এগুলো জনপ্রিয়।
রুফটপ ক্যাফেগুলোয় ছাদের ওপর সবুজে ঢাকা ক্যাফের উষ্ণ পরিবেশ, খোলা মাঠের মনোরম দৃশ্য আর বৈচিত্রময় রান্না উত্তরার জীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।
খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি উত্তরায় বেশ সাশ্রয়ী দামে কেনাকাটাও করা যায়। রাজলক্ষ্মী শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের রাস্তা, আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেট এবং ফুটপাতের দোকানগুলো কেনাকাটার ক্ষেত্রে দারুণ সুলভ কিছু সুযোগ তৈরি করেছে। উত্তরার বাসিন্দারা এসব ভ্যান মার্কেট থেকে কেনাকাটা করতে খুব পছন্দ করেন। সেখানে পাওয়া যায় সিরামিকের তৈজসপত্র, বিছানার চাদর, পর্দা, বিভিন্ন ধরনের পোশাক, গয়না ইত্যাদি।
উত্তরার আশপাশে যেসব গ্রাম এলাকা আছে সেখানকার কৃষকদের জন্যও উত্তরা খুব ভালো বাজার। গ্রামবাসী জৈবসার ব্যবহার করে উৎপাদিত বিভিন্ন শাকসবজি এখানে নিয়ে আসেন এবং উত্তরার মানুষের কাছে তা বিক্রি করেন।
এই এলাকা তুলনামূলক শান্ত, আবার এখানে রয়েছে সমসাময়িক সব সুবিধা সম্বলিত আবাসিক এলাকা। এর প্রাণবন্ত পরিবেশ আপনার মন ভরিয়ে দেবে। মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে উত্তরা শিগগিরই ঢাকার পরবর্তী বাণিজ্যিক এবং সামাজিক কেন্দ্র হয়ে ওঠার পথে হাঁটছে। সেজন্য প্রস্তুতও হচ্ছে উত্তরা।
উত্তরায় গড়ে উঠছে নতুন একটি স্যাটেলাইট টাউন। যেটি হলুদ, সবুজ, নীল, কালো আর গোলাপি রঙে রঙিন। এরপর অপেক্ষা করতে হবে উত্তরার তৃতীয় ধাপের উন্নয়নের জন্য। সেটি চালু হয়ে গেলে আপনারা সবাই-ই নতুন এই শহরতলীর অংশ হতে চাইবেন।
অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments