ফিলিস্তিনে খাবার লাইনেও গুলি, আর কত অনাহার! 

খাবারের জন্য অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি, ছবি: সংগৃহীত

আহমাদ জেইদানের বয়স ১২ বছর। আহমাদের চোখের সামনে ওর মাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মা অভুক্ত পরিবারের জন্য নতুন মার্কিন-সমর্থিত খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে খাবার আনতে গিয়েছিলেন। আহমাদ মায়ের মরদেহের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে ছিল। সে দাঁড়াতে বা দৌড়াতে সাহস করেনি। কারণ সামান্য নড়াচড়া করলেই ইসরায়েলি সেনার গুলিতে তারও মৃত্যু হতে পারত।

আহমাদের মায়ের হত্যা গত ক'দিনে ঘটে যাওয়া বহু হত্যার একটি। এসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে—জিএইচএফ (গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন) পরিচালিত সহায়তা কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বা সেখানে পৌঁছানোর পর।

গাজায় এই গণহত্যার শুরু থেকেই ক্ষুধাকে একটি যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসরায়েল। তারা এই অস্ত্র দিয়ে আমাদের দুর্বল ও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। যখন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে কিছু মানবিক সহায়তা কেন্দ্র চালু হয়, তখন মনে হয়েছিল অনাহার হয়তো কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু এখন সেই ক্ষীণ আশাটুকুও শেষ। এই সহায়তা কেন্দ্রগুলো বর্তমানে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের ভীড়। ছবি: এএফপি
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের ভীড়। ছবি: এএফপি

আমার মনে পড়ে স্কুইড গেমের 'রেড লাইট, গ্রিন লাইট' পর্বের কথা—তবে গাজার কেউই এখানে জেতে না। সবার কেবল শত্রুর হাতে মৃত্যু হয়।

ক্ষুধার্ত মানুষ রোদে পুড়ে উত্তপ্ত বালির ওপর দিয়ে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে নেতসারিম সহায়তা কেন্দ্রে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছে তাদের বাধার সামনে থামতে হয়। তারপর একজন একজন করে ভেতরে ঢুকতে হয়। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায়, যেখানে খাদ্যের বাক্সগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে থাকে—এবং শুরু হয় হাহাকার।

মানুষ মরিয়া হয়ে ছুটে যায় খাদ্যের দিকে। কেউ শুধু আটা বা চিনি নিয়ে চলে যায়, যেগুলোর দাম এখন সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। বাকি জিনিস পড়ে থাকে।  

বিধবা, আহত বা বয়স্কদের অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। পুরো দৃশ্যটা এমন যেন—একটি খাঁচায় মাংস ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, আর ক্ষুধার্ত সিংহগুলো তা নিতে মরিয়া হয়ে লড়াই করছে। সেখানে শেষ পর্যন্ত সবলরাই টিকে থাকে। এরপর মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ট্যাংক চলে আসে। তারা বেড়ার বাইর থেকে গুলি চালাতে শুরু করে। ছোট-বড় সবাইকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।

মানুষ পালাতে শুরু করে, যে যতটুকু পায় তাই নিয়ে দৌড়ায়। কেউ কিছু নিয়ে পালাতে পারে, আর কেউ পালায় খালি হাতে। তারা দেখছে—চারপাশে মানুষ পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ থেমে কাউকে সাহায্য করতে পারেনি। কারণ থামা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে।

কেউ কেউ ফিরে আসে জীবিত। যেমন আমার এক প্রতিবেশী। তিনি চার ঘণ্টারও বেশি সময় পর পরিবারের কাছে ফেরেন। তারপর চিৎকার করে সন্তানদের বললেন, 'বাবা, বাবা, তোমার জন্য রুটি এনেছি! চিনি এনেছি!'

আমি জানালা দিয়ে দেখি, তার সন্তানরা খুশিতে লাফালাফি করছে, বাবাকে জড়িয়ে ধরছে। তিনি ঘামে ভিজে শুধু একটি গেঞ্জি পরে আছেন। তার জামাটা পিঠে বাঁধা, তার মধ্যেই সামান্য খাদ্যসামগ্রী এনেছেন।

মানুষ মরিয়া। মানুষ ক্ষুধার্ত। তবে আমরা খারাপ মানুষ নই। আমরা সহিংস নই। আমরা এমন এক জাতি যারা মর্যাদাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখি। কিন্তু আমরা এখন ক্ষুধার্ত। অথচ আমাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে না।

খাবার অধিকার কোনো বিলাসিতা নয়—এটা মৌলিক অধিকার।

কিন্তু আমরা এখন দুর্ভিক্ষে আছি। বাজারে গেলে কিছুই পাওয়া যায় না। রাস্তায় ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী থাকে, যারা দুর্বলদের কাছ থেকে খাদ্য কেড়ে নেয়। পরে সেই পণ্য চলে যায় ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যবসায়ীরা তা কয়েকগুণ দামে বিক্রি করে।

এর বিপরীতে, ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইনের (ইউএনআরডাব্লিউএ) সহায়তা ব্যবস্থা ছিল একটি মানবিক, সম্মানজনক ও সংগঠিত মডেল।

গাজার জাবালিয়ায় একটি লঙ্গরখানা থেকে শরণার্থীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি
গাজার জাবালিয়ায় একটি লঙ্গরখানা থেকে শরণার্থীদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। ছবি: এএফপি

আমার বাবা ইউএনআরডাব্লিউএ-এর স্কুলের একজন শিক্ষক। তিনি খাদ্য কুপন ও সহায়তা বিতরণে কাজ করতেন। এই সাহায্য দেওয়া হতো পরিচিত, বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের মাধ্যমে। যারা স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় কাজ করতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল—মানুষের মর্যাদা বজায় রাখা। 

এই ব্যবস্থাটি মাসিক চক্রে ভাগ করা ছিল। বড় পরিবারগুলো আগে পেত, পরে ছোট পরিবার। প্রত্যেক পরিবারের একটি নিবন্ধন নম্বর ছিল। তখন গাজার প্রতিটি পরিবার তাদের ন্যায্য অংশ পেত—আটা, গ্যাস, চিনি, তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। সেগুলো সুশৃঙ্খলভাবে কুপনের মাধ্যমে বিতরণ করা হতো।

তখন হয়তো খাবারের বৈচিত্র্য ছিল না, কিন্তু অন্তত আমরা না খেয়ে থাকতাম না। পেট ভরে খেতে পারতাম। অথচ আজ আমরা অনাহারে! এই তথাকথিত মানবিক সহায়তা আদতে কিছুই নয়—এটা শুধুই অপমান। এটা কোনো মানবতা নয়।

(ইসরা আবো কামার একজন ফিলিস্তিনি লেখক, তার এই লেখাটি গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত)

Comments

The Daily Star  | English

Groundwater crisis deepens in coastal Chattogram

Tube wells run dry as salinity and iron contamination rise far above safe limits, leaving residents struggling for drinkable water

21m ago