৪০ মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়

৪০ মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়

সম্প্রতি পরিচিত একজনের কথায় হুট করেই মেজাজটা গরম হয়ে গিয়েছিল। তিনি কিছুটা খোঁচা দিয়েই বলেছিলেন, আমার আচরণ নাকি আজকাল তার কাছে অমার্জিত মনে হয়।

প্রথমে তার কথা শুনে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর একটু গভীরভাবে ভাবতেই, তার কথায় কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং চুপচাপ শুনে যাওয়াই মনস্থ করলাম। ওই ব্যক্তির কথার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম, আমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টবাদী, খোলাখুলি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করি এবং মন যা চায় সেই অনুযায়ী চলি। আমি যে অবশেষে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করতে পেরেছি এবং মানুষের চোখে সেটা ধরাও পড়ছে ভেবে, খুব আনন্দ হচ্ছিল। এক ধরনের মুক্তির স্বাদ অনুভব করছিলাম। আমার সেই পরিচিতের কথার সূত্র ধরেই মনে হচ্ছিল, এসব বৈশিষ্ট্য বরং আমার জীবনে নতুন ধরনের শক্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে।

বহু বছর ধরেই শুনতাম, ৪০ বছর বয়সে নাকি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। তবে আমার জন্য কিংবা আমার দেখা অনেক নারীর জন্য এই বয়সটা হলো সেই সময়, যখন জীবনের নতুন এবং উজ্জ্বল একটা দিক নিজের সামনে উন্মোচিত হয়।

কেন এই সময়টাকে `মিডলাইফ ক্রাইসিস` নাম দেওয়া হয়েছে বুঝি না। আমার বরং মনে হয়, এটা `মিডলাইফ অ্যাওয়েকেনিং`, মানে মধ্যবয়সে নতুন করে জেগে ওঠার সময়। এই সময় একজন নারীর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার, নিজেকে আবিষ্কার করার। অন্যরা নারীর কাছ থেকে কী চায়, সমাজ কী চায়, সেই সব প্রত্যাশার চাপকে এক পাশে সরিয়ে রেখে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করাই তখন সত্যিকার অর্থে গুরুত্ব বহন করে।

গত দশকে আমরা দেখেছি, সমাজ নারীকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে বা কীভাবে দেখতে চায় সেই জায়গা থেকে নারীরা ধীরে ধীরে সরে আসছেন। সিমন দ্য বোভোয়ারের মতো নারীরাও এই গভীর সত্যকে অনুধাবন করতে শুরু করেছেন যে, `কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং ধীরে ধীরে একজন নারী হয়ে ওঠে`।

ঠিক যেভাবে বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার সুলতানার স্বপ্ন উপন্যাসে বলেছিলেন,`'আপনাদের কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের ওপর কর্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই-ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত–আপনাদের সাহায্য অভাবে সমাজ অর্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।'

এরপর বহু সময় পেরিয়েছ। এখন আমরা নিজেরা ৪০ এ পা দিয়ে আর মিডলাইফ ক্রাইসিসে পড়ি না। আমরা বরং নিজেদের অনন্য গল্পগুলো লেখার নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করি।

ছোট ছোট আনন্দ আর বড় বড় স্বপ্ন

প্রতিদিনের ছন্দে বাঁধা জীবনে, মাঝে মাঝেই আমরা আশ্চর্যজনকভাবে নিজের ভেতরেই এক ধরনের শান্তি খুঁজে পাই। এই আনন্দ পাওয়া যায় ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্যে। হতে পারে সেটা কিছুক্ষণ একলা হাঁটার মধ্যে, হতে পারে এক কাপ সবুজ চায়ে কিংবা নিজের ছোট্ট বারান্দায় বসে কেবল অপলক তাকিয়ে থাকায়। আপাতদৃষ্টিতে এই কাজগুলো খুব ছোট হলেও, এর মধ্য দিয়ে একজন নারী ধীরে ধীরে নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে জয় করতে শুরু করেন।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ১৮ বছর বয়সে নিজেকে নিজে একটা চিরকুট লিখেছিলাম আমি। যেখানে ঠিক করেছিলাম, কলেজ শেষ করে সাইকেল চালানো শিখব। এরপর ২৫ বছর পেরিয়েছে! কিন্তু নিজেকে দেওয়া সেই কথা রাখার আর সময় হয়নি। তারপর এই ৪৩ বছর বয়সে এসে মনে হলো, সাইকেল চালানোটা শিখতে হবে। আর সত্যিই আমি শিখে ফেললাম! শেখাটা খুব সহজ ছিল। তবে এর মধ্যে দিয়ে আমি যেটা শিখলাম, সেটা হলো, নতুন কিছুকে আলিঙ্গন করার জন্য বয়স কোনও বিষয় নয়। টলোমলো পায়ে হলেও যেকোনো সময় নতুন পথে ঠিকই হাঁটা যায়।

মনে হচ্ছিল, এখনই আমার সময়, আমার ডানাদুটোকে মেলে ধরার সঠিক সময় এটাই। ৪০ এমন একটা বয়স যখন আমি সাবধান থেকেও নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করতে পারি, নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পারি।

হ্যাঁ, ঠিক যখন আমরা নতুন নতুন সুযোগের অন্বেষণ করছি কিংবা নতুন কোনো ক্ষেত্র জয়ের নেশায় ছুটছি, তখন একজন পুরুষের কাছ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, 'আপনার কী এরইমধ্যে যথেষ্ট অর্জন হয়নি?' মজার ব্যাপার হলো, ৪০ এর পর আমরা সেই প্রশ্নকেও অগ্রাহ্য করতে শিখে যাই, তখন আমরা কেবল নিজের মনের কথা শুনি, মনের পথে চলি।

এটাকে নিজেকে সংজ্ঞায়নের একটি চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেমন ন্যান্সি কোয়ালস-করবেট বলেছিলেন, 'যে মুহূর্ত থেকে একজন নারী নিজের মতো করে চলার সাহস দেখান, সে মুহূর্ত থেকে তিনি অন্যের প্রতিরূপ হওয়া বা অন্যকে অনুকরণ করা বন্ধ করে দেন। আর সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি সত্যিকার অর্থে বাঁচতে শুরু করেন।'

আর আমরা তো সত্যিকার অর্থেই নিজের মতো হতে চাই। তাই না?

আমাদের গ্রাম

চল্লিশে পৌঁছে আমাদের চারপাশে খুব বেশি মানুষ থাকে না। তবে যারা থাকে তারা বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তারা যেন আমার গ্রামের মানুষ, আমার জ্ঞাতি। এরা হয় এমন একদল মানুষ যারা সত্যিকার অর্থে আমাদের বোঝে, উৎসাহ দেয় এবং খুব কোমলভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, এই বয়সে এসেও বড় স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক। আমি এখন নিয়ম করে প্রতিদিন আমার এই 'গ্রামের' একজন নারী বন্ধুর সঙ্গে কথা বলি। এই কথোপকথন আমাদের মানসিক চাপ দূর করে। আমরা নিজেরা আলোচনা করি এবং নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো ভাগ করে নিই।

আমার পরামর্শদাতারা যে যুক্তি দেন তা অমূল্য। সম্প্রতি আমি এদের একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তার কাছে জানতে চাইলাম, জীবনের জটিলতাগুলো তিনি কীভাবে সামাল দেন, জটিলতা বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী?

এটা ঠিক যে, তার সঙ্গে নিজের জটিলতার গল্প বলতে বা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। কিন্তু তিনি চমৎকারভাবে আমাকে সামলে নিলেন। তার পরামর্শটিও ছিল খুব গভীর বোধসম্পন্ন।

তিনি বললেন, 'যখন তোমার মনে এমন প্রশ্ন উঠবে তখন ভেবে নেবে, তুমিই স্বাভাবিক, বাকিরা ভিনগ্রহ থেকে এসেছে।'

তার এই কথায় সত্যিই আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। এখন আমি সেভাবেই চিন্তা করি এবং খেয়াল করে দেখলাম এতে আমার ভেতর যে গুমোট ভাব থাকে, তা অনেকটাই হালকা হয়ে যায়।

ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়

'চমৎকার ৪০' বছর নারীর জন্য অনেক সময় নিয়ে আসে দারুণ আর্থিক স্বাধীনতা, যা তাকে শক্তিশালী অনুভব করতে সহায়তা করে। এটা এমন একটি সময় যখন আমাদের মধ্যে অনেকেই কৌশলগত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলি, গত ৩০ জুনের আগেই আমি ভবিষ্যতের জন্য একটি সঞ্চয় প্রকল্পে বিনিয়োগ করার সাহস দেখিয়েছি। যা আগে কখনও ভাবিনি।

প্রশ্ন করতে পারেন, নিজের জীবনের এই বয়সে আমি ব্যক্তিগত কোন মাইলফলক ছুঁয়েছি? উত্তর হবে, ৪০ পেরোনোর পর আমি প্রথম নিজের জমি কিনেছি। যদিও একা একা এই কাজে সফল হইনি, আমার কাছের কিছু বন্ধুকেও এই বিনিয়োগে রাজি করিয়েছি।

এমনকি আমার একজন হোমমেকার বন্ধুও তার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে নিজের নামে জমি কিনেছে। কারণ সে আর্থিক স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পেরেছে।

যেদিন আমার সন্তানকে নিজের নামে কেনা জমিটুকু দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, কী যে তৃপ্তি অনুভূত হচ্ছিল! তাকে এটাও বোঝাতে চাইছিলাম যে, তার আর্থিক নিরাপত্তা মা-বাবা দুজনেই কাছ থেকে আসবে।

এই সক্ষমতা আমার অন্তর্দৃষ্টিও খুলে দিয়েছিল। আমি ছেলেকে বললাম, আমার যদি একটি মেয়ে হয় তাহলে এই সম্পত্তি দুজনের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেব। তখন উত্তরে সে বলল, 'এমনটিই তো হওয়া উচিত'।

আমার ছেলে এত চমৎকারভাবে চিন্তা করতে পারে, সেটা ভেবেও সেই সময় খুব শান্তি পেয়েছিলাম।

আমরা যদি এভাবেই সন্তানদের বড় করতে পারি যেখানে তারা উত্তরাধিকার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে, তাহলে এর ফলাফলটা হবে দারুণ। তাদের এই বিকশিত দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতকে সুসংহত করবে। তাদের এই প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা সমাজে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করবে এবং এক সময় নিশ্চয়ই পরিবর্তন তাদের হাত ধরেই আসবে।

সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা

৪০ এ পৌঁছে আমাদের শরীরে কিছু পরিবর্তন আসবে, যার কথা মোটেও ভুলে গেলে চলবে না। হুট করে হটফ্ল্যাশ অনুভূত হতে পারে, হঠাত করে গরম লাগতে শুরু করতে পারে। দেখা গেল আশপাশের সবার ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু আমরা এসি বা ফ্যানের বাতাস বাড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এরপরেও হয়তো ঘামছি। মনে রাখতে হবে, এ সবই স্বাভাবিক।

আবার দেখা যাবে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে শরীর জয়েন্টগুলোতে টান ধরেছে, ব্যথা লাগছে। হতে পারে চল্লিশের পর চুল পড়তে শুরু করবে, কপালে পড়বে সূক্ষ্ম ভাঁজের রেখা। তবুও যখন আমরা আয়নায় নিজেদের দেখব, তখন এসব চোখে পড়বে না। আমরা বরং দেখব চোখ ভরা স্বপ্ন, আর তা বাস্তবায়নের অটল দৃঢ়তা।

আমি যখন আমার মেয়েবন্ধুদের নিয়ে বিশেষ কোনও ডিনারে যাই, তখন নিজেদের এই সমস্যা নিয়ে নিজেরাই হাসাহাসি করি। আমাদের ঠোঁটের দুপাশে পড়ে যাওয়া বয়সের ভাঁজ, পাতলা হয়ে যাওয়া চুল, ভুলে যাওয়ার সমস্যা, চোখের পাওয়ার বেড়ে যাওয়া এবং হরমোনের অদ্ভুত ওঠানামা নিয়ে নিজেরাই হেসে আকুল হই।

আমরা খালি বাসায় একাকিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার আশঙ্কা নিয়ে কথা বলি। সেইসঙ্গে মা-বাবা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের আলোচনায় উঠে আসে হার্ট অ্যাটাক বা দুর্ঘটনায় নিহত সমবয়সী বন্ধুদের কথাও। এসব আলোচনায় মন ভারী হয়, কিন্তু যখন ভাবনাগুলো ভাগ করে নিই তখন মনটা হালকা লাগে।

এই যে সম্মিলিত আড্ডা, প্রাণবন্ত সময় কাটানো; এগুলো অনেক নারীকে শক্তিশালী করে। তার ভেতরের স্ফুলিঙ্গকে জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করে। সমাজের কাছ থেকে সবসময় সহানুভূতি না পেলেও আমরা একই বয়সী নারীরা একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি দেখাই বা আমাদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার সম্পর্ক থাকে। সবসময় হয়তো মুখেও বলা হয় না, কিন্তু আমরা বুঝে নিই যে একে অন্যের পাশে আছি।

আমাদের মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকে, পাশাপাশি থাকলে শক্তিশালী বোধ করি। এই বয়সটি নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়ার, নিজের সীমানা নিজেই ভেঙে বেরিয়ে পড়ার এবং নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের। আমাদের আগের প্রজন্মের নারীরাও এভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের শৃঙ্খল ভেঙেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের নারীরাও আমাদের দেখে শিখতে পারে। ৪০ বছর বয়সে এসেই আমরা চাইলে নিজেদের দুনিয়াকে সমষ্টিগতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। এটাই তার জন্য সঠিক সময়।

লেখক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস প্রতিষ্ঠান স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোংএর অংশীদার এবং হারস্টোরি ফাউন্ডেশন ও চলপড়ির প্রতিষ্ঠাতা।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments