ফিরে দেখা জুলাই গণঅভ্যুত্থান

জুলাই ২১: আদালতের রায়ের পরও শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, সহিংসতা অব্যাহত

ঢাকার মাতুয়াইলের একটি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা। ২১ জুলাই, ২০২৪। ফাইল ছবি: এমরান হোসেন/ স্টার

আগের কয়েকদিনে দেশজুড়ে ভয়াবহ সহিংসতায় শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অসংখ্য মানুষ হতাহতের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য কার্যত কোটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন অনেকে। আশা ছিল, এর মাধ্যমেই সহিংসতা ক্রমশ কমে আসবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

কিন্তু চব্বিশের ২১ জুলাই টানা দ্বিতীয় দিনের মতো কারফিউ চলাকালীন আপিল বিভাগের শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হলেও তা মানেননি আন্দোলনকারীরা।

এদিনও কারফিউয়ের মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন নিহত হওয়ার খবর আসে। এছাড়া আহত অবস্থায় আগে থেকেই চিকিৎসাধীন সাতজন হাসপাতালে মারা যান।

২১ জুলাই সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে এ রায় দেন।

রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।

তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে। এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

রায়ে আরও বলা হয়, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।

সুপ্রিম কোর্টের এ রায়কে স্বাগত জানায় সরকার। প্রতিক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, আপিল বিভাগের রায়কে শিক্ষার্থীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

এ অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুতে শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে চার দফা দাবি পূরণে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। ওই দাবিগুলো ছিল- ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা, শিক্ষার্থীদের আসার ব্যবস্থা করে দিয়ে হল খুলে দেওয়া, আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কারফিউ তুলে দেওয়া।

কিন্তু একই দিনে 'বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি' শিরোনামে একটি বার্তা গণমাধ্যমকর্মীদের মুঠোফোনে পাঠানো হয়।

ওই যৌথ বিবৃতিতে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে হত্যার দায় এড়াতে পারে না সরকার।

বিবৃতিতে 'তিন শতাধিক' ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এছাড়া সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদারসহ কয়েকজনের সন্ধান দাবি করা হয় ওই বিবৃতিতে।

এদিকে রায়ের পরও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় কারফিউ অব্যাহত থাকে। সাধারণ ছুটির আওতায় স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানাসহ সব কলকারখানা বন্ধ রাখা হয়।

চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হলো নাহিদকে

শুক্রবার মধ্যরাতে আটকের একদিন পর রোববার ভোরে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে।

নাহিদের বাবা বদরুল ইসলাম জানান, আটকের পর তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এর আগে ঢাকার নন্দীপাড়ার একটি বাসা থেকে নাহিদকে আটকের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে নাহিদ ইসলামকে আটক বা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ বা কোনো বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

পরে নাহিদ বলেন, ডিবি পরিচয়ে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। তুলে নেওয়ার পর একটি প্রাইভেট কার বা মাইক্রোতে ওঠানো হয়। তিন থেকে চার স্তরের কাপড় দিয়ে তার চোখ বাঁধা হয় এবং হ্যান্ডকাফ পরানো হয়। কিছু সময় পর গাড়ি থেকে নামিয়ে একটি বাড়ির রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিক টর্চার শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। এরপর কোনো স্মৃতি তার মনে নেই।

রিমান্ডে আমির খসরু মাহমুদ ও নুরুল হক

২১ জুলাই বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায় ও গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

এর আগে রামপুরায় বিটিভি ভবনে আগুন এবং সেতু ভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ীতে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির অভিযান

২১ জুলাই রোববার কারফিউয়ের ভেতর রাজধানীর শনির আখড়া ‍ও যাত্রাবাড়ীতে চলা বিক্ষোভ দমনে অভিযান চালায় র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন গুলি ছোড়ে, তেমনি বিক্ষোভকারীরাও ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি অনেক জায়গায় আগুন দেয়। গুলিতে নিহত হন অন্তত পাঁচজন।

আগের দিন শনিবারও এই এলাকায় ব্যাপক সহিংসতায় অন্তত ১০ জন নিহত হন; যার মধ্যে পুলিশের দুই সদস্যও ছিলেন।

এছাড়া রোববার ঢাকায় কারফিউয়ের ভেতর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও রামপুরাসহ কয়েকটি জায়গা থেকেও সহিংসতার খবর আসে।

ঢাকার বাইরে নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও চট্টগ্রামেও চলে সহিংসতা।

নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগের পর্যায়ে ফেরার আশাবাদ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর

২১ জুলাই রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'সোমবার বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। পাঁচটার পর আবারও কারফিউ শুরু হবে'।

এছাড়া তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, সারাদেশে কারফিউ অব্যাহত থাকলে সাধারণ ছুটিও বাড়ানো হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আসাদুজ্জামান খান কামাল আরও বলেন, মঙ্গলবার থেকে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী এবং গাজীপুরের কারফিউ কতদিন চলবে, কতক্ষণ শিথিল থাকবে তার সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাকি জেলাগুলোতে এ সিদ্ধান্ত নেবে জেলা প্রশাসন।

সাবেক এই মন্ত্রী সেদিন জানান, প্রতিদিন সকাল আটটার পর থেকে জেলা প্রশাসন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা কাজ করছেন তারা সবাই সমন্বয়ের ভিত্তিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

কামাল ওই রাতে আশা প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে এনেছে। দুই- চারদিনের মধ্যে দেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগের পর্যায়ে ফিরবে।

Comments

The Daily Star  | English

AL govt’s secret surveillance state

From snooping devices carried in backpacks to locate people through their phones to a massive infrastructure that can intercept even end-to-end encryption from a central command centre, the Awami League government had been on an increasingly aggressive trajectory towards building a powerful surveillance state. 

17h ago