৫০ বছর পূর্ণ করা কালজয়ী এই বাংলা সিনেমাটি দেখেছেন?

লাবণ্য: কালের এক দূর-দূরান্তে ছিলাম আমি, আমরা। ইতিহাস ধরে যদি ফিরে যাও আলোর গতিতে, তাহলে পলকে পৌঁছে যাবে সেখানে। হেসে-খেলে বেড়াতাম আমরা। ওই বিশাল সূর্য ছিলেন আমাদের পিতা।
লেনিন: মানে সূর্যকন্যা?
লাবণ্য: হ্যাঁ, সৃষ্টির উৎস ছিল তারা। মুক্ত আনন্দে সুখের উল্লাসে দিন কাটত তাদের। তারপর দেখতে দেখতে কী যেন হয়ে গেল! যাদেরকে অন্তরের ভালোবাসা শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু দিয়ে তিল তিল করে সৃষ্টি করলাম, হৃদয়ে দিলাম স্পন্দন, মুখে দিলাম ভাষা—তারাই একদিন রূপ নিলো ভয়ংকর রাহুর। সূর্যকন্যাদের তারা বন্দি করে রাখল কালের অন্ধকারে।
লেনিন: তারা কারা?
লাবণ্য: শক্তিতে মত্ত পুরুষ। তার পরের ইতিহাস এক ভয়াবহ দাসত্বের ইতিহাস। তাই আজ আমাদের নেই কোনো স্বকীয়তা। আমরা কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ভোগের সামগ্রী।
উপরের সংলাপের অংশটুকু আলমগীর কবীর পরিচালিত কালজয়ী চলচ্চিত্র 'সূর্যকন্যা'-র অংশ। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'সূর্যকন্যা' সিনেমার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। সংলাপগুলো পড়লে বোঝা যায়, এখানে আলোকপাত করা হয়েছে সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় ব্যক্তিসম্পদের বিকাশ ও নারীর মুক্তজীবন থেকে পুরুষের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ার ওপর।
সিনেমায় লেনিন (বুলবুল আহমেদ) একজন চিত্রশিল্পী। ধনাঢ্য বাবা কিংবা ডাক্তার ছোট ভাইয়ের কটাক্ষের শিকার তিনি। কারণ, তিনি তাদের মতো করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। লেনিন স্বপ্ন দেখে সাম্যবাদী সমাজের। কল্পনায় রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে ভাষণ দেয়৷ সেখানে সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, অবৈতনিক শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলেন তিনি।
মূলত সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক চিন্তার লেনিন চায় তার শিল্পকর্ম দিয়ে পৃথিবীতে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। তিনি অনুভব করেন প্রকৃতিকে, ভালোবাসেন মানুষকে। কল্পনায় তিনি মারামারি করে গুন্ডা-মাস্তানের সঙ্গে, কিন্তু বাস্তবে সেটা তিনি করতে পারেন না। তাই নিজের জায়গা থেকে যতটা সম্ভব মানুষকে সাহায্য করেন। এই 'লেনিন' নামটি আলমগীর কবির নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের নাম থেকে।
এবার আসা যাক লাবণ্য প্রসঙ্গে। লাবণ্য (জয়শ্রী কবির) একটি ম্যানিকুইন। লেনিন তার বন্ধু রাসেলের (আহসান আলী সিডনী) দোকানে কাজ নেয়৷ এই দোকানেই সাজিয়ে রাখা একটি পুতুলের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। তার কাছে পুতুলটি জীবন্ত এক মানুষ হয়ে ধরা দেয়৷ তারপর এই পুতুলের মুখেই উঠে আসতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় নারী নিপীড়নের, নারীকে ভোগ্যপণ্য মনে করার চিত্র। উপরের কথোপকথন আমাদের সেদিকটিরই ইঙ্গিত দেয়। এক্ষেত্রে, আলমগীর কবীরের ব্যবহার করা মেটাফোরটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রায়শই আমাদের সমাজে নারীকে পুরুষের ইচ্ছার অধীন ও ঊনমানুষ হয়ে থাকতে হয়৷ তাই দোকানে সাজিয়ে রাখা পুতুলের ভেতর দিয়ে নারীর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা—সবকিছু প্রকাশ করেছেন পরিচালক আলমগীর কবীর।
সিনেমায় দেখানো রাসেল আবার চরিত্র হিসেবে লেনিনের একেবারেই বিপরীত। তিনি আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক এক চরিত্র। তারই দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মনিকা (রাজশ্রী বোস) তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাকে ভালোবেসেছিল৷ কিন্তু মনিকাকে তিনি ভোগসামগ্রীর বাইরে মানুষ মনে করতে পারেনি। মনিকা তাকে বিয়ের কথা বলার পর তাদের কথোপকথনে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়:
মনিকা: এতদিনের এসব কি তাহলে মিথ্যে?
রাসেল: নাহ, মিথ্যে নয়। তবে বিয়ে, আর নয়। মনি, লিসেন, ভালোবাসি বলেই আমাদের বিয়ে করা উচিত নয়।
মনিকা: কেন?
রাসেল: বিয়ের ঘানিতে সবকিছু নিংড়ে বেরিয়ে যায়। আই ডিড ইট ওয়ান্স। আই নৌ।
মনিকা: তাহলে বলে দাও কী করবো?
রাসেল: ওকে ভালো লাগলে বিয়ে করো।
মনিকা: তারপর শুধু হাড়ি ঠ্যালো আর বছর বছর বাচ্চা বিয়োও।
রাসেল: তবুও স্ত্রীর মর্যাদা পাবে। আর টাকার জন্য ভেবো না।
মনিকা: থাক, আর অপমান করো না।
তাদের এই কথোপকথন রাসেলের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি তুলে ধরে মনিকার প্রখর আত্মসম্মানবোধ ও স্বাধীন হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও। মনিকা নিজের মতো করে স্বাবলম্বী হতে চায়, রাসেলের দোকানের চাকরিটিও ছেড়ে দেয় পরবর্তীতে।
এদিকে লেনিন কল্পনায় লাবণ্যর সঙ্গে ঘুরতে যায় সমুদ্রপাড়ে, তাদের দেখা হয় আরও নানান জায়গায়। 'আমি যে আঁধারের বন্দিনী' গানটিতে পুতুল থেকে সত্যিকার মানুষ হওয়ার ও মুক্তি চাওয়ার আকুতিই প্রতিফলিত হয়৷
সিনেমাটিতে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মানব সমাজের বিবর্তন ও পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অন্তরীণ হয়ে পড়ার ব্যাপারটিও তুলে ধরা হয়েছে, যা সে সময়ের হিসেবে খুবই অভিনব একটি ব্যাপার।
এছাড়া, লেনিনের চরিত্রের মাধ্যমে সামাজিক বাধা ভাঙার আভাসও দিয়েছেন আলমগীর কবির। আমাদের সমাজে সাধারণত বড় ভাইয়েরা ছোট বোনদের প্রেম করতে দেখলে বাধা দেয়। কিন্তু লেনিন এর বিপরীত। তিনি ছোট বোনের কাছে পৌঁছে দেয় তার প্রেমিকের চিঠি। সেই প্রেমিক একজন কবি, যার চাল-চুলো নেই, যে প্রতিষ্ঠিত নয়। বড় বড় বৈষয়িক প্রতিষ্ঠার চেয়ে লেনিনের কাছে কবিতার সৌন্দর্যই বড় হয়ে ওঠে।
এভাবে 'সূর্যকন্যা' সিনেমাটির গল্প লেনিন-লাবণ্য ও রাসেল-মনিকার দুটি সমান্তরাল ধারায় এগিয়েছে। দুটো ধারাতেই আমরা নারীদের মুক্তির প্রতীতী পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।
এক্ষেত্রে, একটি বিষয় উল্লেখ্য। আলমগীর কবীর কিন্তু লাবণ্যকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে দেখাননি। দেখিয়েছেন ম্যানিকুইন বা পুতুল হিসেবে। এর কারণ স্পষ্টভাবে বলা যায় না। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রায়শই পুতুল হিসেবে ফাংশন করতে বাধ্য হওয়া নারীকে কিংবা বলা যায়, স্বাধীন ইচ্ছাহীন নারীকে পুতুলের প্রতীকে দেখাতে চেয়েছেন আলমগীর কবীর। এখানে পুতুলটি তার মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, তা হয়ে ওঠে জীবন্ত নারীর ক্ষেত্রেও সর্বজনীন।
আলমগীর কবীরের 'সূর্যকন্যা' তাই সময়কে অতিক্রম করে সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। কালজয়ী এই চলচ্চিত্রটি এ বছর ৫০ বছর পূর্ণ করলো। পাঁচ দশক পেরিয়েও সিনেমাটি এখনো জীবন্ত, এরকমই থেকে যাবে আরও বহুকাল।
Comments