টানা ৫ বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলোর লোকসান ৫০০ কোটি টাকার বেশি

টানা পঞ্চম বছরের মতো ৫০০ কোটি টাকার বেশি বার্ষিক লোকসান গুনেছে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো। ব্যয় কমানোসহ বড় আকারে লোকসানি কলগুলো বন্ধ করার পরও লোকসানের ধারা অব্যাহত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) সর্বশেষ আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫০৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৫৫৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। সে তুলনায় গত অর্থবছরে লোকসান কিছুটা কম।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ করা হয় 'আধুনিকায়ন' পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সেই বছরে, অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনিকলগুলোর লোকসান সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৬ কোটি টাকায় পৌঁছায়।

পাবনা, শ্যামপুর, পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, রংপুর ও কুষ্টিয়া চিনিকল বন্ধের উদ্দেশ্য ছিল লোকসানের এই ধারা বন্ধ করা।

তারপরও অতি পুরনো যন্ত্রপাতি, অতিরিক্ত জনবল ও কম ফলনশীল আখের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত বাকি চিনিকলগুলোও।

আখ থেকে চিনি উৎপাদনের বৈশ্বিক গড় হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের মিলগুলোতে এই হার মাত্র সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ।

বিএসএফআইসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ চিনি উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় প্রতি কেজি ২৬০ টাকা। যেখানে এই চিনি বিক্রি হয় ১২৫ টাকা কেজি দরে। ফলে, প্রতি কেজিতে লোকসান হয় ১৩৫ টাকা।

প্রতিযোগী বেসরকারি ব্র্যান্ডগুলো ১১০ থেকে ১১৫ টাকা দরে চিনি বিক্রি করায় সরকারিভাবে উৎপাদিত চিনির চাহিদা আরও কমছে। যদিও বিএসএফআইসি দাবি করে, তাদের চিনি প্রাকৃতিকভাবে প্রক্রিয়াজাত ও গুণমানে উন্নত।

দামের এই বড় পার্থক্যের কারণে দেশের চিনিকলগুলোতে উৎপাদিত চিনি বিক্রি না হওয়া মজুদ জমে থাকছে।

দেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা প্রায় ২২ লাখ টন। সে তুলনায় বিএসএফআইসির উৎপাদন ও বিক্রি খুবই নগণ্য। তারপরও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসএফআইসি ৪৬ হাজার ১৯৭ টন চিনি উৎপাদন করেছে এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত গুদামগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার টন রয়ে গেছে।

মজুদ কমাতে বিএসএফআইসি ভর্তুকি মূল্যে সরকারি খাদ্যপণ্য বিতরণ কর্মসূচির সঙ্গে অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিএসএফআইসি কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যদি সরকারি সংস্থাগুলো আমাদের মজুদের অন্তত ৫০ শতাংশ কিনে নেয়, তাহলে তারা যেমন মানসম্পন্ন চিনি পাবে, তেমনি আমরাও লোকসান কমাতে পারব।'

চালু থাকা নয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে রাজশাহী সুগার মিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬৬ কোটি টাকা লোকসান দেখিয়েছে।

একসময় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১৩ কোটি টাকা। সেটা কমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৩৮ কোটিতে।

মোবারকগঞ্জ সুগার মিল মাঝে কিছুটা উন্নতি করলেও তাদের লোকসান আবার ৭০ কোটিতে পৌঁছেছে।

একমাত্র কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে—যা আগের বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। তবে এই মুনাফা হয়েছে কেবল তাদের ডিস্টিলারি ব্যবসা থেকে। চিনি ইউনিটের লোকসান ৬০ কোটির বেশি।

বন্ধ চিনিকলগুলোর মধ্যে সেতাবগঞ্জ, রংপুর ও কুষ্টিয়া তাদের লোকসান ৩০ কোটির নিচে রাখতে পেরেছে।

আগের চেয়ে লোকসান কমার কারণ হিসেবে সীমিত কার্যক্রম, জনবল পুনর্বিন্যাস ও বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমে যাওয়ার কথা জানান বিএসএফআইসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রধান মো. সাইফুল্লাহ।

তবে তিনি স্বীকার করেছেন, কাঠামোগত সমস্যাও রয়েছে।

তিনি বলেন, 'আমরা পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে কম উৎপাদনশীল ফসল প্রক্রিয়াজাত করছি। আবার সেখান থেকে লাভের আশাও করছি। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক না।'

দেশের অর্থনীতি ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো গ্রামীণ জীবিকা ও জলবায়ু সহনশীলতায় সহায়ক। প্রতি বছর ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হয়। এর ফলে হাজারো কৃষকের জীবিকা নির্বাহ যেমন হয়, তেমনি আখের বন্যা সহনশীলতার কারণে বন্যার ঝুঁকি কমায়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম লোকসানি চিনিকলগুলো বন্ধ করে কেবল লাভজনক কেরু অ্যান্ড কো. (বাংলাদেশ) লিমিটেড রাখা এবং বিএসএফআইসির সম্পদ ও দায়ের আন্তর্জাতিক নিরীক্ষার সুপারিশ করেছেন।

তিনি প্রস্তাব দেন, 'অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রি করে ঋণ ও ভূমি মালিকানা নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে করে রপ্তানিমুখী উৎপাদন, দেশীয় শিল্প বা অর্থনৈতিক ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে সেগুলো যুক্ত করার মতো বিকল্প পথ খোলার সুযোগ তৈরি হবে।'

মোয়াজ্জেম বলেন, 'উদ্যোক্তাদের সাশ্রয়ী ও নিষ্কণ্টক জমি দেওয়া গেলে বিনিয়োগ ও শিল্পের বৈচিত্র্য বাড়বে।'

তিনি উল্লেখ করেন, মূল লক্ষ্য হলো ভর্তুকি ও লোকসান কমানো, সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই শিল্পভিত্তি গড়ে তোলা।

বিএসএফআইসি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহও তেমনটাই মনে করেন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'স্বল্পমেয়াদি সমাধান কখনোই কার্যকর হবে না। এর জন্য সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।'

শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সরকার দীর্ঘমেয়াদি লোকসানি কলগুলো বন্ধ বা বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও শ্রমিক প্রতিরোধের কারণে সংস্কার থমকে আছে। তার পাশাপাশি নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় এখনই বড় ধরনের পুনর্গঠনের সম্ভাবনা কম।'

সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক শর্করা ইন্টারন্যাশনাল, থাইল্যান্ডের সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিং ও জাপানের মারুবেনি প্রোটেকসের সঙ্গে যৌথভাবে ছয়টি বন্ধ চিনিকল আধুনিকায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের অধীনে ২০১৯ সালের একটি স্থগিত পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৩ সালে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে হওয়া বিতর্কিত চুক্তি বাতিলের পর নতুন করে এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গত ২৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক বৈঠকে বিএসএফআইসি ও সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিং একটি সম্ভাব্যতা জরিপ পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Fugitives can’t run in national elections

The Election Commission has proposed stricter amendments to the election law, including a provision barring fugitives from contesting national polls.

9h ago