ঘরে-বাইরে ‘বিপদে’ নরেন্দ্র মোদি?

বেঙ্গালুরুতে নরেন্দ্র মোদি ভক্তদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। ছবি: এএফপি (১০ আগস্ট, ২০২৫)
বেঙ্গালুরুতে নরেন্দ্র মোদি ভক্তদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। ছবি: এএফপি (১০ আগস্ট, ২০২৫)

গুজরাট থেকে দিল্লির রাজপথে তিনি এসেছিলেন মহারাজার মান্যতা নিয়ে। দিল্লি তার কাছে খুব দূরের পথ ছিল না। গুজরাট থেকে দিল্লি—দূরত্ব প্রায় এগার শ কিলোমিটার। তবে বিধানসভা থেকে লোকসভা—অনেকের কাছে তা যোজন যোজন দূরের হলেও, তার কাছে তা যেন ছিল এক লহমার। তিনি নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

২০০১ সালে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। পরের বছর সেই রাজ্যে দাঙ্গা বাঁধলে তা দমনে ব্যর্থ হন তিনি। তখনই তার নাম জেনে যান বিশ্ববাসী।

টাইম মেশিনে চলে আসা যাক ২০১৪ সালের ভারতে। সারাদেশ তখন কেঁপেছিল 'মোদি-ঝড়ে'। বিরোধীদের ভাষায় 'মোদি-জ্বরে'। তখন তিনিই ছিলেন মহামতি-মহামহিম। তারই নেতৃত্বে বিজেপি জয় করেছিল বহুল প্রত্যাশিত 'লালকিল্লা'। তার কারিশমায় ধসে পড়েছিল ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেসের গড়; হয়েছিল সব বিরোধীর 'কিল্লা ফতেহ'। সেই সাল থেকে বিজেপি বা ভারতের রাজনীতিতে শুরু হয় 'মোদি যুগ'।

গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

সে সময় তার কথাই ছিল মহা-ভারতের শেষ কথা। তার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন ভূ-ভারতের শিরোমণি। কেননা, দেশটির ৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৩৬ ও বিজেপি এককভাবে পেয়েছিল ২৮২ আসন।

নরেন্দ্র মোদির বিজয় রথ বীর-বিক্রমে এগিয়ে চলতে থাকে গোয়া থেকে গুয়াহাটি, কাশ্মীর থেকে কন্যকুমারিকা। তথা, আ-সমুদ্র হিমাচল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি আবির্ভূত হন 'অবতার' হয়ে। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন 'ভারত বিধাতা'। এবার তার নেতৃত্বে বিজেপি লোকসভায় ৩০৩ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তার এনডিএ জোট পায় ৩৫৩ আসন।

এমন অভানীয় ফল তার মনে 'ঈশ্বর-প্রেরিত' পুরুষ হওয়ার গৌরব জাগায়। জনসম্মুখে সেই গৌরব প্রকাশও করেন তিনি। এর ফল আসে ২০২৪ সালে। বিজেপি পায় ২৪০ আসন। হারায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এনডিএর ঝুলিতে আসে ২৯৩ আসন।

'ভোট চুরি'র তকমা

গত ১১ আগস্ট ভারতবাসী দেখল এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। ঘটনাটি ঘটেছিল রাজধানী নয়াদিল্লিতে। সেদিন বিরোধীদলের সদস্যরা যেতে চেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে। তাদের অভিযোগ—ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন বিজেপির অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করছে।

বিষয়টি নিয়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা এক ভিডিওতে রাহুল গান্ধী দেখিয়েছেন কীভাবে একই ভোটারকে বিভিন্ন এলাকায় নিবন্ধিত করা হয়েছে। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার বাড়ানো হয়েছে। এভাবে বিজেপির পক্ষে কাজ করেছে নির্বাচন কমিশন।

রাহুলের দাবি, গত বছরের জাতীয় নির্বাচনে অনেক এলাকা তারা চিহ্নিত করেছেন যেখানে মাঠ পর্যায়ে বিজেপির সমর্থন সামান্যই, কিন্তু ভোটে জিতেছে 'পদ্মফুল'। তার ভাষ্য, বিজেপি যদি আর ১০-১৫টি আসনও কম পেত তাহলে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে হতো না।

অভিযোগের ব্যাপারে বিজেপির বক্তব্য—ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়মিত প্রক্রিয়া। কমিশন নিজের কাজের অংশ হিসেবে সেই তালিকা হালনাগাদ করছে।

আর নির্বাচন কমিশন বলছে—২০০৩ সালের পর ভোটার তালিকা সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি সংশোধন করতে গিয়ে কমিশন যদি ভুল করে থাকে তাহলে তা ধরিয়ে দেওয়া হোক।

সেসব 'ভুল'—এর কথা বলতে কমিশনে যাওয়ার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে বিরোধীরা। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি হিসেবে কমিশনের কার্যালয়ে যাওয়া পথে বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেসনেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীসহ লোকসভার অন্তত ৩০ সদস্যকে আটক করে পুলিশ। মুহূর্তেই সেই সংবাদ চলে যায় সারা দেশে।

পুলিশের ভাষ্য, নির্বাচন কমিশন কেবল ৩০ এমপিকে কার্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা 'সংখ্যায় বেশি' ছিলেন। সবার নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।

পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন কথায় কান না দিয়ে বিরোধীরা আরও উচ্চবাচ্য হন। বলেন—তারা সংবিধান, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে কমিশনের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কমিশন তাদের কথা তো শুনেনি, উল্টো তাদেরকে দেখা করার সুযোগও দেয়নি।

গণমাধ্যমে প্রশ্ন উঠে—নির্বাচন কমিশন কি ক্রটিপূর্ণ ভোটার তালিকা দিয়েই ২০২৪ সালের নির্বাচন সেরেছিল? যদি তাই হয় তাহলে বর্তমান বিজেপি সরকার কি অবৈধ?

গত ১২ আগস্ট কলকাতা টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়—লোকসভা ভেঙে সারা দেশে স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরির দাবি করেছেন তৃণমূলের লোকসভা সদস্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এখন সেই দাবি বিরোধী জোটের অন্যসব নেতাদের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে।

বিক্ষোভ মিছিল থেকে তাদের আটক করা হয়। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা—কোনো কারণে জোট ভেঙে গেলে বিজেপিকে আবার পথে নামতে হবে ভোট ভিক্ষা করতে। ভোটের মাঠে মোদি-জৌলুস কমতে শুরু করেছে। বিরোধী ইন্ডিয়া জোট ২৩৪ আসন ও কংগ্রেস ৯৯ আসন নিয়ে এখন বেশ উজ্জীবিত।

গতকাল বিবিসির এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'ভারতীয় রাজ্যে নতুন ভোটার তালিকায় ভুল ছবি ও মৃত মানুষ'। এতে বলা হয়, বিহার রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন আগামী নভেম্বরে। সে কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশন হালনাগাদ ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করেছে।

অনেক ভোটার গণমাধ্যমটিকে বলেছেন, নতুন তালিকায় ভুল ছবি ও মৃতদের নাম আছে।

তথ্য সংশোধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি আবেদন পড়েছে।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে—বিহারে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা থেকে প্রায় ৬৫ লাখ নাম বাদ দিয়েছে। কমিশন তাদেরকে 'ভুয়া' ভোটার হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তাদের অনেকে মৃত, আবার অনেকে বিহার ছেড়ে চলে গেছেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের রাজনীতিতে প্রবল প্রভাবশালী মানুষটিকে এখন বিরোধীদের কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে 'ভোট চুরি'র অভিযোগ।

বন্ধু বেইমান?

গত বছর তৃতীয়বারের মতো দিল্লির মসনদে বসার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদিকে বেশ ম্রিয়মান দেখা যাচ্ছে। জোট-সঙ্গীদের বিশ্বাসের ওপর ভর করে সরকার চালাতে হচ্ছে তাকে। শুধু যে ঘরেই বিপদ তা নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে চলছে শীতল সম্পর্ক।

গত ৭ মে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত। সেসময় অন্য প্রতিবেশীদের পাশে পায়নি নয়াদিল্লি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে নিজেদের বিজয়ের কথা দেশবাসীকে সদর্পে জানানো হলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তা তেমন বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। উল্টো, সেই চার দিনের যুদ্ধে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির কথা বেশি প্রচার পেয়েছে বিদেশি সংবাদমাধ্যমে।

এককালের দুই বন্ধু এখন একে অপরের ছায়াও মাড়ান না। ফাইল ছবি: রয়টার্স
এককালের দুই বন্ধু এখন একে অপরের ছায়াও মাড়ান না। ফাইল ছবি: রয়টার্স

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন 'বিশ্বাসহীনতা'। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধের কৃতিত্ব দাবি করায় তা মোদির শক্তিমত্তার পাদপ্রদীপের ওপর পড়ে অবিশ্বাসের কালো ছায়া।

ট্রাম্পকে নিজের 'বন্ধু' হিসেবে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রচার করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই বন্ধুকেই এখন 'বেইমান' আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অপর বন্ধু ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া থেকে তেল কেনায় মোদির ভারতের ওপর হোয়াইট হাউস চাপিয়ে দিয়েছে ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা। মোদির ভাষ্য—ভারতের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা না নোয়ানোর প্রত্যয়।

গত ৮ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিনের 'হাউ মোদি মিসরেড ট্রাম্প' প্রতিবেদনে বলা হয়, '(ট্রাম্প-মোদি) বন্ধুত্বের দিন শেষ। ব্যক্তিগত রসায়ন বৈশ্বিক স্বার্থের নিরস গণিতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।'

সবকিছু বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন জাগে—তাহলে কি ঘরে-বাইরে 'বিপদে' আছেন নরেন্দ্র মোদি?

 

Comments

The Daily Star  | English

At least 10 incidents in 7 years: Why clashes between CU students and locals keep happening

Housing shortage, resentment, and administrative inaction blamed for repeated clashes

1h ago