আউশ ধানে জুটত ৪ মাসের খাবার, ভেসে গেল অপ্রত্যাশিত বন্যায়

অতিবৃষ্টির প্রভাবে হঠাৎ বৃদ্ধির পর ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে পদ্মার পানি। এর সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চরাঞ্চলের দুই ইউনিয়ন চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুরে। তবে স্বস্তিতে নেই ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা ওই জনপদের বাসিন্দারা। বন্যার পর এখন দিন কাটছে আকালের আশঙ্কায়। গ্রামের পুরুষরা কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বন্যাদুর্গত এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শুধুমাত্র চিলমারী ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামের ছয় হাজার বিঘা পাক ধরা আউশ ধান, ছয়-সাত হাজার বিঘা কলা, হাজারো বিঘা পাট, পেঁপে, মরিচসহ সবজির খেত সবই এখন পানির নিচে।
বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনের সময় চিলমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মান্নানের সঙ্গে দেখা হয় মানিকের চরে। সেখানে ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন তিনি। কাজের ফাঁকে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৪৬ বর্গ মাইলের চিলমারী ইউনিয়নের ৮০ ভাগ জমিতেই কৃষিকাজ হয়। এবার সব ফসলই বন্যায় নষ্ট হয়ে গেল।'

নিজ এলাকায় আকালের আশঙ্কা জানিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, 'চরাঞ্চলে বন্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার আগাম বন্যায় প্রায় ছয় হাজার বিঘা পাকা আউশ ধান বন্যায় ডুবে গেছে। কৃষিনির্ভর এই এলাকার মানুষের চার মাসের খাবার আসে এই ধান থেকে। এবার একমুঠো ধানও তাদের ঘরে উঠছে না।'
প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের দিকে বন্যা হয় জানিয়ে আব্দুল মান্নান আরও বলেন, 'আর মাত্র ১০-১৫ দিন সময় পেলেই কৃষক ধান ঘরে তুলে ফেলতে পারত। কিন্তু এবার আগাম বন্যা সব শেষ করে দিল। এই ক্ষতি অপূরণীয়।'
মানিকের চরের মুদি দোকানি জামাল জানান, বন্যায় তার ১০ বিঘা পেঁপে বাগান ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তিনি বলেন, 'গত তিন বছর বন্যা হয়নি। এবার হঠাৎ করে বন্যা হয়েছে। দুই-তিন দিনেই চোখের সামনে সব ডুবে গেল।'
চিলমারীর সব চর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, এরমধ্যে মানিকের চরের অবস্থান পদ্মার ঠিক মাঝখানে। এবারের বন্যায় এই চরের পূর্ব দিকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টির মতো ঘর বিলীন হয়েছে। সেখানকার বাসিন্দারা গবাদি পশু-পাখি, শুকনো খাবার সরিয়ে নিয়েছেন। সেখানকার বাসিন্দা জলিল বলছিলেন, 'বহু বন্যা দেখেছি, কিন্তু এবারের বন্যা ছিল ডাকাতের মতো। নিমিষে সব কেড়ে নিয়েছে। কোনো সহযোগিতাও এখনো পাইনি আমরা।'
এদিকে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও দৌলতপুর উপজেলা প্রশাসনের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুরের এক হাজার হেক্টর (এক হেক্টরে প্রায় সাড়ে সাত বিঘা) ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুষ্টির উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামানও দ্য ডেইলি স্টারকে একই তথ্য জানিয়েছেন। তবে বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে আসা দৌলতপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হাই সিদ্দিকী বলছেন, বন্যায় অন্তত ৫০ হাজার বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
আব্দুল হাই সিদ্দিকী বলেন, চিলমারী ইউনিয়নের ৮০ ভাগ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। এখানে পানির উচ্চতা বর্তমানে ছয়-সাত ফুট। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝামাঝি পানি বাড়তে শুরু করে। সপ্তাহের ব্যবধানে পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে।
আব্দুল হাই জানান, 'চিলমারী ইউনিয়নকে দৌলতপুরের শস্যভান্ডার বলা যায়। এখানে বহু ধরনের ফসল হয়। এই উর্বর মাটি ডুবে এলাকার মানুষ বড় ক্ষতির শিকার হলো। মানুষ আগামী তিন-চার মাস কোথায় খাবার পাবে, কীভাবে জীবনধারণ করবে, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেল।'
বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, প্রায় প্রতিদিনই ১০-১২ সেন্টিমিটার করে পানি কমছে। আশা করা যায়, বন্যা পরিস্থিতির দ্রুতই উন্নতি হবে।
Comments