চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন

চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা করার সরকারি আশ্বাসের পর গত শনিবার ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। কিন্তু, শ্রমিকদের একটি অংশ ৩০০ টাকা দৈনিক ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। আমরা চা-শ্রমিকদের এই অংশকে সমর্থন করি।
চা-শ্রমিক
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকা করার সরকারি আশ্বাসের পর গত শনিবার ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। কিন্তু, শ্রমিকদের একটি অংশ ৩০০ টাকা দৈনিক ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। আমরা চা-শ্রমিকদের এই অংশকে সমর্থন করি।

১৪৫ টাকা মজুরি শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত না হওয়ায়, মজুরি বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য ন্যায্য নয়। কর্মবিরতি অর্থনৈতিক দিক থেকে বাধা হলেও হতদরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পৌঁছানোর এটিই একমাত্র উপায়। শ্রমিকদের নিরীহ কণ্ঠস্বর মালিকদের কাছে পৌঁছানোর অন্য কোনো উপায় নেই।

সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় ১৬৬ চা-বাগানের শ্রমিকরা গত ১৩ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন। চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ও সবচেয়ে প্রান্তিক। তবুও গত ৮ দিন ধরে তারা বাগানে কাজ করছেন না।

বাংলাদেশ চা সংসদের (সিলেট) চেয়ারপারসনের মতে, এতে 'বিশাল ক্ষতি' হচ্ছে। বাস্তবে শ্রমিকদেরই বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। কর্মবিরতিতে থাকায় তারা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন না। বিক্ষোভের প্রতিটি দিন তারা আরও দরিদ্র হচ্ছেন।

ট্রেড ইউনিয়নের সমর্থন ছাড়া আন্দোলন চালিয়ে যেতে তাদেরকে যথেষ্ট সাহসী হতে হয়েছে। সত্যি বলতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তারা এ সাহস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুসারে, দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ চা-শ্রমিকই দরিদ্র। বিবিএসের এই পরিসংখ্যান মেনে নিলেও শ্রমিকদের এই সংখ্যাটি অনেক বড়। দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

সুতরাং, ২৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়-বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক নয়। এটি শোষণের ঐতিহাসিক ধারা, যেখানে শ্রমিকরা তাদের 'প্রভুদের' সেবা দিতে বাধ্য।

যদিও শ্রমিকদের আবাসন, রেশন ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু, শ্রমিকদের সবাই আবার সেসব সুবিধা পান না। এসব সুবিধা নিম্ন মজুরিকে ন্যায্য দাবি করার জন্য যথেষ্ট নয়।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে চা-শ্রমিকরা তাদের দুর্দশা বর্ণনা করেছেন। এসবের মধ্যে আছে—চাকরি নিয়মিতকরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা, বাইরে কাজের সুযোগ সঙ্কুচিত হওয়া, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দারিদ্র্যের বোঝা টানা ইত্যাদি।

একজন বিশেষজ্ঞের মতে, চা-শ্রমিকরা আমাদের বনাঞ্চলের মোট ২৫ শতাংশের দেখভাল করেন। এজন্যও তো তাদের বিশেষভাবে কিছু পাওয়া উচিত।

আমরা মনে করি, চা-শ্রমিকদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার চেয়ে তাদের প্রতি ন্যায্য আচরণ বেশি জরুরি। ন্যায্য আচরণের শুরু হতে পারে তাদের কাজের যথাযথ মজুরি নির্ধারণের মধ্যে দিয়ে।

বাগান মালিকদের শোষণের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শ্রমিক ও বাগান মালিকদের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিধি প্রতিষ্ঠা করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে চা-শিল্পের পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের দিকে নজর দেওয়া উচিত।

বর্তমানে, বাংলাদেশ বিশ্বে দশম বৃহত্তম চা উত্পাদনকারী দেশ। তা সত্ত্বেও ২০২০ সালে চা রপ্তানিতে বাংলাদেশ ৬১তম অবস্থানে ছিল। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, রপ্তানির এই খাতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়েছে।

সুতরাং, এই খাতের আধুনিকীকরণ ও বৈচিত্র্য প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন নিবেদিত কর্মী। বর্তমান সংকটকে কাজে লাগিয়ে এ খাতকে এগিয়ে নিতে এবং এ খাতের উন্নয়নে শ্রমিকদের জন্য আরও ভালো প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি।

 

Comments