নাগরিকের মোবাইল ফোন চেক করার এখতিয়ার পুলিশকে কে দিলো

একটা অদ্ভুত খবরে চোখ আটকে গেল। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পরদিন ৮ ডিসেম্বর বিডিনিউজের একটি খবরের শিরোনাম: 'গাজীপুরে পুলিশের তল্লাশি, চেক করা হচ্ছে ফোনের মেসেজ'।

এদিন 'ঢাকার প্রবেশমুখে তল্লাশি, সড়কে বাস কম, যাত্রী ভোগান্তি' শিরোনামে ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত একটি খবরে রবিউল আলম নামে একজনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, গাবতলীর একটি স্কুলে তার ছেলে পড়াশোনা করে। ছেলের জন্য শীতের কাপড় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু চেকপোস্টে দাঁড় করিয়ে পুলিশ অযথা ৫ মিনিট ধরে তল্লাশি করেছে। তার ভাষায়, 'এটা নিছক হয়রানি ছাড়া কিছু নয়।' (ডেইলি স্টার অনলাইন, ৮ ডিসেম্বর ২০২২)।

একই খবরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার শফিকুল ইসলাম আরিফকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি বিআরটিসি বাসে করে একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে মতিঝিল যাচ্ছিলেন। চেকপোস্টে আরও ৫ থেকে ৭ জনের সঙ্গে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নামানো হয়। প্রায় ৫ মিনিট ধরে তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। পরবর্তীতে তার মোবাইল ফোনও চেক করেন দায়িত্বরত ২ পুলিশ কর্মকর্তা।

বিডিনিউজের খবরে বলা হয়, ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগে গাজীপুরে মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিটি গাড়ি ও যাত্রীদের তল্লাশি করছে পুলিশ। দূরপাল্লার বাসের গতিরোধ করে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ, ব্যাগ, বস্তার পাশাপাশি মুঠোফোনের বিভিন্ন অ্যাপসের মেসেজ, ছবিও চেক করা হচ্ছে। শিপন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'দুপুরে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা যাচ্ছিলাম। টঙ্গী ব্রিজের উত্তরপাশে পৌঁছানোর পর পুলিশ বাস থামিয়ে তল্লাশি করে। সে সময় আমার স্মার্ট ফোন নিয়ে পুলিশ ফেসবুক, ইমু, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে।' তবে তল্লাশির নামে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না বলে দাবি করেন কালিয়াকৈর থানার এসআই আজিম হোসেন। (বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ৮ ডিসেম্বর ২০২২)।

রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে সরকারবিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করা; গ্রেপ্তার করা; সন্দেহভাজন কাউকে ৫৪ ধারায় আটক করা এমনকি বিরোধী মতের লোকজনের ওপর লাঠিপেটা করাও পুলিশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। আবার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মাদক মামলার আসামি করার অভিযোগও আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার চেক করার মতো ঘটনার খবরও আমাদের পড়তে হলো এমন এক দিনে, যার ঠিক দুদিন পরেই ১০ ডিসেম্বর দিনটি সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশও দিনটি উদযাপন করে। যে দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মানবাধিকার দর্শন নিয়ে ৩৬০ পৃষ্ঠার একটি বইও প্রকাশ করেছে। (বঙ্গবন্ধুর মানবাধিকার দর্শন, মে ২০১৩)।

১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে, 'কারো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়াল-খুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আ‌ইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকের‌ই রয়েছে।'

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে।' এখানে যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের মধ্যে টেলিফোন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

তার মানে কারো মোবাইল ফোনের গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের তরফে হয়তো বলা হতে পারে যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে পথচারীদের মোবাইল ফোনের মেসেজ চেক করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেই কি এটা জায়েজ হয়ে যায়? একটা আধুনিক সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য একজন নাগরিকের মোবাইল ফোন চেক করতে পারে, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় বা যতক্ষণ না তাকে বড় কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়?

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ফোনালাপ ফাঁস নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছিল। তখনো এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ছাড়া কারো ফোন কল রেকর্ড করা এবং সেই ফোনকল ফাঁস করে দেওয়া ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন কি না?

ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ (ফাঁস) নিয়ে দেশের কোনো আইনে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। টেলিযোগাযোগ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, যদি নিরাপত্তা সংস্থা প্রয়োজন মনে করে, তদন্তের ও মামলার স্বার্থে কারও ফোনালাপ নিতে পারে। তাহলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে; কিন্তু তারা যে কারও ফোনে আড়িপাততে পারবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা নেই।

শোনা যায়, গুরুত্বপূর্ণ সবার ফোনালাপই রেকর্ড হয় এবং যখন যারটি প্রয়োজন হয়, তখন তারটি ফাঁস করা হয়। যাদের ফোনালাপ ফাঁস হয়, তাদের বাইরেও রাষ্ট্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিজের দল ও সরকার পরিচালনার স্বার্থে নেতাকর্মী ও সংশ্লিষ্টদের নানা ধরনের পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। এসব নির্দেশনা ও পরামর্শ কি ভবিষ্যতে ফাঁস হবে? প্রশ্নটি যতটা না রাজনীতির, তার চেয়ে বেশি নৈতিকতা ও মানবাধিকারের।

শুধু ফোনালাপ নয়, মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অডিও-ভিডিওসহ নানা তথ্য প্রকাশের ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন তথা ডিজিটাল দুনিয়া যত বেশি প্রসারিত হচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ইস্যুটি তত বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনে মানুষ এখন অফিসিয়াল বিষয়ের বাইরে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। কারণ সবার মনেই এই প্রশ্ন বা সংশয় কাজ করে যে, ফোনকলটি রেকর্ড হচ্ছে কি না, বা কেউ আড়ি পেতে আছেন কি না! এই আতঙ্কে অনেকে মোবাইল ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চান না। অনেকেই মোবাইল ফোনের সাধারণ কলের বদলে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথা বলেন। অথচ এখন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পুলিশ যদি নাগরিকদের হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো টেক্সট, ছবি বা ভিডিও চেক করে— যেখানে একজন নাগরিকের খুব ব্যক্তিগত কোনো জিনিসও থাকতে পারে— রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন বা নীতি কি সেটাকে সমর্থন করবে? মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক মানুষেরই সম্মান রয়েছে। অধিকার রয়েছে। আদালতে কেউ দোষী বা অপরাধী প্রমাণিত হলে সেই অপরাধীরও মানবাধিকার রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে কিংবা এর দোহাই দিয়ে পুলিশ যে নাগরিকদের মোবাইল ফোন চেক করছে, তার উদ্দেশ্যটা কী? পুলিশ কি মেসেজ চেক করে দেখতে চাইছে যে কেউ বিএনপির নেতাকর্মী বা সমর্থক কি না? যদি মেসেজ দেখে এটা বোঝাও যায় যে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাহলে কি পুলিশ তাকে আটক করবে? কেউ যদি সত্যিই বিএনপির সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে রওনা হন এবং তল্লাশির সময় তিনি যদি পুলিশের কাছে সত্য বলেন যে তিনি ঢাকায় বিএনপির সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন, তখন পুলিশ কি তাকে আটক করবে?

রাজধানীর প্রবেশদ্বারগুলোয় পুলিশের তল্লাশি বেশি এবং বাস থামিয়ে চেক করার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। উদ্দেশ্য কী? একটি বড় দলের সমাবেশে অংশ নিতে সারা দেশ থেকে লোক আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সরকার তো এই সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না— এমন কোনো ঘোষণা দেয়নি। কিন্তু পুলিশের আচরণে মনে হচ্ছে কোনো একটি নিষিদ্ধ সংগঠন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এই অতি উৎসাহের কারণ কী? নাকি সরকারের নির্দেশেই পুলিশ এরকম অতি উৎসাহী আচরণ করছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে সেটি আরও দুঃখজনক। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে, অতি উৎসাহীরাই দ্রুত রঙ বদলায়।

পরিশেষে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ— যাদের বেতন হয় সাধারণ মানুষের করের অর্থে— রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তল্লাশির নামে তারা নাগরিকদের মোবাইল ফোন চেক করতে পারে না। যদি এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকে, তাহলে অতি উৎসাহীদের থামানো দরকার। আর যদি এরকম নির্দেশনা দেওয়া হয় তাহলে, সেই নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করা উচিত। কারণ এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago