আওয়ামী লীগের জন্য ‘বিশেষ ট্রেন’ বিএনপির জন্য ‘পরিবহন ধর্মঘট’

রাষ্ট্রীয় সম্পদ মানে জনগণের সম্পদ, বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নয়। সেই দলটি দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকলেও নয়। এর ব্যতিক্রম যে কখনো হয়নি, তা নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের নজিরগুলো অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ মানে জনগণের সম্পদ, বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নয়। সেই দলটি দেশের শাসন ক্ষমতায় থাকলেও নয়। এর ব্যতিক্রম যে কখনো হয়নি, তা নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের নজিরগুলো অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম।

রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ রাজশাহীর সমাবেশ উপলক্ষে ব্যতিক্রমী নজির তৈরি করতে যাচ্ছে। সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্যে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রশ্ন এসেছে, একটি রাজনৈতিক দল এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে পারে কি না।

বলে রাখা দরকার, আমরা রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের কাছেই ফিরে যাই বা ফিরে যেতে চাই। কারণ, পৃথিবীতে এটা প্রমাণিত সত্য যে রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনা করলেই দেশ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়।

রাজনীতির বাইরের কোনো শক্তি দেশ পরিচালনা করলে সেই দেশটির পরিণতি কী হয়, আমাদের আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাকিস্তান। দেশটি বর্তমানে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে।

পাকিস্তানের চেয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভারতের কম নেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো বেশিই আছে। কিন্তু ভারত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে সব ধরনের জটিলতা কাটিয়ে দিন দিন একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে।

আমাদের সব সময়ের প্রত্যাশা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসবে। যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্যতা, ন্যায্যতা তথা সুশাসন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাম্যতা বা ন্যায্যতার ও সুশাসনের অনুপস্থিতি যেন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় প্রকাশিত নাটোর প্রতিনিধি বুলবুল আহমেদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আগামী ২৯ জানুয়ারি রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

এটা 'রাজনৈতিক দল' আওয়ামী লীগের সমাবেশ, আওয়ামী লীগ 'সরকারের' সমাবেশ নয়। রাজশাহীতে এই 'রাজনৈতিক দলের' সমাবেশ উপলক্ষে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন কেন উঠছে? দেশের একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যোগদানের সুবিধার জন্য যদি একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়, তাতে সমস্যা বা ক্ষতির কী আছে?

এতে সমস্যা বা ক্ষতির চেয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে।

প্রথমত, একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশের জন্যে রাষ্ট্রীয় ট্রেনের 'বিশেষ' ব্যবস্থা করা হবে কেন? যেখানে সাধারণ জনগণের জন্যে পর্যাপ্ত ট্রেন সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। রয়েছে যাত্রী অনুপাতে ট্রেনের স্বল্পতা।

দ্বিতীয়ত, বিএনপি যখন রাজশাহীতে সমাবেশের আয়োজন করেছিল তখনকার পরিস্থিতি, সরকারি দলের কথা-বার্তা, আচার-আচরণ কেমন ছিল?

বিএনপি ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দিয়েছিল যে ৩ ডিসেম্বর তারা রাজশাহীতে সমাবেশ করবে। সমাবেশের আগে ১ ডিসেম্বর ভোর ৬টা থেকে রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। শুধু তাই নয়, ঘোষিত সময়ের আগে থেকেই এই পরিবহন ধর্মঘট কার্যকর করা হয়।

এ ধর্মঘটে বাস, ট্রাক, থ্রি-হুইলারসহ যত ধরনের পরিবহন আছে, সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশেপাশের সব জেলার সঙ্গে রাজশাহীর যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে, রাজশাহীর আশেপাশের জেলাগুলো থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সমাবেশে যোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

বিএনপি নেতাকর্মীরা এই সমাবেশে যোগ দিতে পারবে না—এমন চিন্তা থেকেই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট ডেকেছে, এখানে সরকারের কিছু করার নেই। আসলে যে বিষয়টি তা নয়, সেটা সাদা চোখে খুব স্পষ্ট করেই দেখা যায়। সরকারের আকার-ইঙ্গিতেই এসব ঘটনা ঘটে।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির সমাবেশে মানুষ যেন যোগ দিতে না পারে, সেজন্যই কি পরিবহন ধর্মঘট, কয়েক কিলোমিটার আগে থেকে পুলিশি চেকপোস্ট-তল্লাশি, বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে অভিযান, গ্রেপ্তার? আর আওয়ামী লীগের সমাবেশ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা!

একই দেশে ২ রাজনৈতিক দলের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ২ রকমের নীতি কেন হবে?

আমরা ধরেই নেই যে সরকারে যারা থাকবে তারা কিছু বাড়তি সুবিধা পাবে। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে ব্যবহার করবে? তারা অপর একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি এমন আচরণ করবে? তাহলে আমরা যে সাম্যের কথা বলি, ন্যায্যতার কথা বলি, সেটা আসলে কী?

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সমাবেশস্থল ও এর আশেপাশের এলাকার থ্রিজি-ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।

রাজশাহীতে গত ৩ ডিসেম্বর যখন থ্রিজি-ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর জন্য বিটিআরসি থেকে 'নির্দেশনা' দেওয়া হয়েছে।

বিটিআরসি 'নির্দেশনা' দিয়ে রাজশাহীতে থ্রিজি-ফোরজি সেবা বন্ধ করল, এতে কি শুধু বিএনপি নেতাকর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্ত বা বঞ্চিত হলেন? সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হলেন না?

পরিবহন ধর্মঘটের কারণে যখন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মানুষ যাতায়াত করতে পারেননি, তখন কি শুধু বিএনপি নেতাকর্মীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন? ওই পুরো অঞ্চলের সব মানুষ কি বিএনপির সমর্থক বা নেতাকর্মী? সরকারি আচরণের কারণে সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ, তার ব্যাখ্যা কী?

এই ব্যাখ্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। করলেও সরকার তা ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।

রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে যখন কর্তৃত্ববাদ কায়েম করে, ভোটারবিহীন নির্বাচনে বা রাতে ভোটের নির্বাচনে বারবার বিজয়ী হয়, তখন জনমানুষের ভেতরে রাজনীতি বিদ্বেষ মনোভাব গড়ে ওঠে। মানুষ সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদী সরকারের তুলনা করে, যা রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের জন্য শুভ নয়।

ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা দাবি করেন, আমরা ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, এখান থেকে কিছু পেতে আসিনি, জনগণের সেবা করতে এসেছি।

জনগণের সেবা করতে আসা নিঃসন্দেহে ভালো বিষয়। কিন্তু এই যে থ্রিজি-ফোরজি সেবা বন্ধ করে দেওয়া, এতে কি জনগণ সেবা পায়? এই যে পরিবহন ধর্মঘট, এতে কি জনগণের সেবা হয়?

জনগণের সেবার অর্থ কী? এর অর্থ কি ক্ষমতাসীন হয়ে নিজের রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা সমর্থকদের সেবা করা? বিরোধী দলের যারা আছে, তারা কি এ দেশের নাগরিক নয়? তাদের কি সেবা পাওয়ার অধিকার নেই?

মানুষের ভোটের অধিকার থাকছে না, নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সব কিছুর দাম হু হু করে বাড়ছে, সরকার এর তোয়াক্কা করছে না।

সরকার জনগণের কথা বিবেচনায় না রেখে জ্বালানি তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করছে। প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে, ডলার সংকট তৈরি হচ্ছে, অর্থপাচার হচ্ছে, ডলার পাচার হচ্ছে। এসব বিষয়ে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, সেসব ক্ষেত্রেও সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

একটি উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করি। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ তখন ক্ষমতায়। তাকে হটাতে আন্দোলন করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল ও ৫ দলের বামজোট। তখন জনসমর্থনহীন এরশাদ ঢাকায় সমাবেশের জন্যে আদমজী জুট মিলের উৎপাদন বন্ধ রেখে থেকে ১৫-২০ হাজার শ্রমিক নিয়ে আসত। আদমজী জুট মিলের সবচেয়ে বড় ক্ষতির সূচনা তখন থেকেই। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে বিশাল ও বিপুল সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের  জুট মিলটি বন্ধ করে দেয়।

এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যদি ট্রেনের এমন রাজনৈতিক ব্যবহারের ধারা চালু হয়, তার পরিণতি কি আমরা ভাবছি-ভাববো?

[email protected]

Comments