সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা

আসল অপরাধী ছাত্রলীগের ‘অধিকার বোধ’

'রাজনৈতিক পরিচয়' ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, বিশেষত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এই রাজনৈতিক পরিচয় তাদেরকে আইন, নিয়ম, নীতি—প্রকারান্তরে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৫ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কারের বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশে আমরা আনন্দিত। এই আদেশে সংশ্লিষ্ট প্রভোস্টকে প্রত্যাহার ও ফুলপরীর জন্য হলে আসন নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

ছাত্রলীগও ওই ৫ নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে। তবে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কি না, সেটা বোঝা যাবে তখনই, যখন সংগঠনটি একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত সব সদস্যকে বহিষ্কার করবে।

বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আদেশ দেওয়ার সময় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং উল্লেখ করেন, 'আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, কিছু অবাধ্য শিক্ষার্থী তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপ্রীতিকর ঘটনায় অংশ নিচ্ছে, যা ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে।'

'রাজনৈতিক পরিচয়' ব্যবহারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, বিশেষত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মনে করেন, এই রাজনৈতিক পরিচয় তাদেরকে আইন, নিয়ম, নীতি—প্রকারান্তরে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ছাত্রলীগের সঙ্গে সাধারণত যে আচরণ করে, তাতেই প্রমাণিত হয় যে তাদের এই ধারণা সঠিক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে আসলে কী হয়, তার একটি খণ্ডচিত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। তিনি তার অভিজ্ঞতা জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন। ইবি ছাত্রলীগ নেত্রীদের হাতে তিনি কীভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তা সবাইকে জানিয়েছেন। ফুলপরীর অপরাধ ছিল ছাত্রলীগ নেত্রীদের অনুমতি ছাড়াই দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে উঠা। হলটির নামকরণ যেহেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নামে হয়েছে, তাই সবার প্রত্যাশা থাকতেই পারে যে এই হলটিকে একটি অনুকরণীয় মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হবে। যেখানে সবাই, বিশেষত ছাত্রলীগ অনুকরণীয় আচরণ করবে।

অনুমতি ছাড়া হলে ওঠায় ফুলপরীকে বলা হয় একজন নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এবং তিনি ৪৮ পর দেখা করতে যান। এ ধরনের অবাধ্যতার জন্য তাকে 'শিক্ষা' দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কয়েকদিনব্যাপী দুর্ব্যবহারের পর ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টা ফুলপরীর ওপর চলে নির্যাতন। সাধারণত এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা এতোটাই ভয় পান যে তারা হল থেকে পালিয়ে যান কিংবা পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হলে সেই সুযোগও পান না। সে ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ভাগ্যকে বরণ করে নিয়ে অপমান ও দুর্ভোগের কথা পুরোপুরি চেপে যান। আমরা আগেও এ ধরনের ঘটনার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের অনেকেই মুখ খুলতে রাজি হননি এবং বলেছেন, 'আপনাদের এর পরিণাম সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই'।

কিন্তু, ফুলপরী ব্যতিক্রম। তার বাবা একজন ভ্যানচালক, যিনি গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে প্রকৃতির শত প্রতিকূলতায়ও ৩ চাকার বাহনটি চালিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করেছেন। ফুলপরী নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে সংকল্পবদ্ধ হন। এই সংকল্পে ফাটল ধরাতে পারেনি তার ওপর নির্যাতনের পরিকল্পনাকারী ও নির্যাতনকারী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তার সহযোগীরা। ফুলপরী জনসম্মুখে এসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ জানান, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং হাইকোর্টের নির্দেশে জেলা প্রশাসন ২টি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি করে।

উভয় তদন্ত প্রতিবেদনেই ফুলপরীর ওপর হওয়া নির্যাতনের বিস্তারিত তথ্য জানা গেছে। তাকে মারধর করা হয়েছে এবং সানজিদার 'পা ধরে' মাফ চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। এক পর্যায়ে সানজিদা উপস্থিত সবাইকে নির্দেশ দেন পর্যায়ক্রমে ফুলপরীকে থাপ্পড় মারতে, যেটা তার শাস্তি। প্রভোস্টের সামনেই এই অত্যাচার চলতে থাকে। ফুলপরীকে একটি কক্ষে আটকে নির্যাতনের ভিডিও করা হয়—যে ভিডিওটি এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন ভিডিওটি আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে।

ফুলপরীর বর্ণনা খুবই স্পষ্ট। তিনি যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তা ভয়াবহ এবং হল প্রশাসনের আচরণ ক্ষমার অযোগ্য। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আজকাল এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কেন সহপাঠীদের প্রতি ছাত্রলীগের আচরণ এতোটা নির্মম হয়ে উঠেছে? আদর্শের অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মূল সংগঠনের অবক্ষয়, লাগামহীন দুর্নীতি, কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা অন্যদের নির্যাতন করলে কোনো জবাবদিহিতা না থাকাসহ এর আরও অনেক কারণ রয়েছে। তবে আমাদের দৃষ্টিতে আসল সমস্যা 'অধিকার বোধে', যা ক্ষমতাসীন দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, বিশেষত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। তারা মনে করেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকানা কার্যত তাদেরই হাতে এবং তারা ইচ্ছামতো এই 'অধিকার' প্রয়োগ করেন ভর্তি, হলের আসন বণ্টন, নিয়োগ, পদোন্নতি, নির্মাণ কাজ থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই। কাজ যাই হোক না কেন, যদি সেখানে আর্থিক সুবিধা আদায় বা ক্ষমতার ভিত্তি আরও বলিষ্ঠ করার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেগুলো তাদের মাধ্যমেই হতে হবে। নানা দিক দিয়ে তারা একটি বিকল্প প্রশাসন তৈরি করেন। উপাচার্যরা অনেক সময় ছাত্রলীগের চাপে ও চাপ সৃষ্টির ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। সাধারণ আবাসিক শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সবচেয়ে অন্যায্য কাজগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, ছাত্রলীগের সব ধরনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করা। এতে যদি কারো ক্লাসও বাদ পড়ে, তাতেও রেহাই নেই। নিঃসন্দেহে এখানে ভিন্নমত পোষণের কোনো উপায় নেই।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে বের করে দিয়েছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের, হলে তৈরি করেছিল আতঙ্কজনক পরিস্থিতি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের রাজনীতির এ ধরনের সর্বময় ক্ষমতা পাওয়ার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ক্ষমতা অবক্ষয়ের অব্যাহত ধারা। উপাচার্য, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর ও অন্যান্য প্রশাসনিক সংগঠনগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা ও নিজের চেয়ার ঠিক রাখতে তারা ছাত্রলীগকে নিজেদের পাশে রাখার গুরুত্ব খুব ভালো করেই বোঝেন। কিছু উপাচার্যের (সবাই নয়) নাম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ায় বড় আকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের অঘোষিত, কিন্তু সুপরিচিত সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সম্প্রতি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে এনেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিষ্ঠিত চর্চা ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক রাজনৈতিক কার্যক্রম। এতে কোনো ক্ষতিও নেই। আমাদের জন্য যে বিষয়টি ধ্বংসাত্মক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তা হলো, এক শ্রেণির শিক্ষক বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তাধারা ত্যাগ করে 'সব কিছুর ঊর্ধ্বে দল' মনোভাবকে আঁকড়ে ধরেছেন। ফলে 'গুরু' হিসেবে শিক্ষকের মর্যাদা অনেক নিচে নেমে এসেছে। অথচ, আমাদের সংস্কৃতিতে শিক্ষকের অবস্থান অনেক ওপরে এবং প্রায় বিনা প্রশ্নে তাদের এই অবস্থান মেনে নেওয়া হয়। শিক্ষকরা যেসব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই দলের ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। কারণ উল্লেখিত শিক্ষকরাও নির্বাচনে জেতার জন্য শিক্ষার্থীদের ওপর নির্ভরশীল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলীয় রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রশাসনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যার ফলে 'শিক্ষার ঊর্ধ্বে রাজনীতি'র ধারা চালু হয়েছে। এই ধারাটি ধ্বংসাত্মক, রাজনীতি নয়।

আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোর সাক্ষী এবং একইসঙ্গে যারা শিক্ষকদের সততা ও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে দেখার গৌরবময় স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে রেখেছি, তাদের কাছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের বর্তমান অবস্থা দেখতে পাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যা স্বস্তিদায়ক।

এমন একটি সময় ছিল যখন ছাত্ররাজনীতি জাতিকে আশা, আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ দিয়েছে, বিশেষত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আজ এটা শুধুই হতাশা, দুর্দশা এবং খুবই দুঃখজনক ভাবে, আতঙ্কের উৎস।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments