‘বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন’

এই অঞ্চলে শুধু মিয়ানমার আছে বাংলাদেশের নিচে। তাদের অবস্থান ১৭৩। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ, এমনকি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও বাংলাদেশের উপরে। তাদের অবস্থান যথাক্রমে ১৫০ ও ১৫২। এ ছাড়া, ভারত ১৬১, শ্রীলঙ্কা ১৩৫, নেপাল ৯৫, ভুটান ৯০ এবং মালদ্বীপ ১০০তম।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সাংবাদিকতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স ২০২৩ সালের যে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে, সেখানে ১৮০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম। অর্থাৎ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। ২০২১ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২৷ সে হিসাবে, ২ বছরে ১১ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

এবার এই অঞ্চলে শুধু মিয়ানমার আছে বাংলাদেশের নিচে। তাদের অবস্থান ১৭৩। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ, এমনকি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানও বাংলাদেশের উপরে। তাদের অবস্থান যথাক্রমে ১৫০ ও ১৫২। এ ছাড়া, ভারত ১৬১, শ্রীলঙ্কা ১৩৫, নেপাল ৯৫, ভুটান ৯০ এবং মালদ্বীপ ১০০তম।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালে এই সূচকে প্রতিবেশী সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার নিচে, এমনকি মিয়ানমারেও নিচে। এ বছর অবশ্য মিয়ানমারের উপরে আছে।

যদি বলা হয়, বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনেক স্বাধীন, মুক্ত—সেটি কি ভুল হবে? যেমন: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সূচক বলছে, উত্তর কোরিয়া, ইরিত্রিয়া, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইরাক ও সিরিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। তার মানে, এসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো।

পক্ষান্তরে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরাধীন, শৃঙ্খলিত। যেমন: নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, কোস্টারিকা, লিথুয়ানিয়া, লিশটেনস্টাইন।

অর্থাৎ, দুটিই সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন সত্যটি আমরা গ্রহণ করব বা বিবেচনায় নেব?

উদাহরণটি এভাবেও দেওয়া যায় যে, এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেই দেশের লাখো মানুষের চেয়ে ভালো আছেন। যেমন: আপনি তাদের চেয়ে শারীরিকভাবে বেশি সুস্থ, তাদের চেয়ে ভালো চাকরি করেন, ভালো বাসায় থাকেন, ভালো খাবার খান, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে যান ইত্যাদি।

আবার যারা এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেই উল্লিখিত মানুষদের চেয়ে কম উপার্জন করেন, খারাপ বাসায় থাকেন, খুব ভালো খাবার খেতে পান না, অসুখ হলে উন্নত চিকিৎসা পান না, সন্তানকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারেন না ইত্যাদি।

ফলে এই জনগোষ্ঠীর লক্ষ্য কী হবে? সারা জীবন তারা এই অভাব-অনটন আর সংকটের ভেতরে বসবাস করবেন? নাকি জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করবেন? নাকি তারা এই ভেবে আত্মতুষ্টিতে ভুগবেন যে তারচেয়েও অনেকে খারাপ আছেন? তারচেয়ে আরও বেশি অভাব ও সংকটাপন্ন মানুষ আছেন—এই ভেবে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে তারা ভাগ্যলিপি হিসেবে মেনে নেবেন? আমরা কোন থিওরিটা নেব, গ্লাসের অর্ধেক ভর্তি নাকি অর্ধেক খালি?

অস্বীকার করার উপায় নেই যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশ বরাবরই নিচের দিকে থাকে। যেমন: দুর্নীতির ধারণা সূচক, আইনের শাসনের সূচক, গণতন্ত্রের সূচক, বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক, ডুয়িং বিজনেস (ব্যবসার পরিবেশ) সূচক ইত্যাদি। এমনকি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেদিন (২৫ জুন ২০২২) তার আর্থিক সক্ষমতা ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাহস ও স্পর্ধার ফলক উন্মোচন করলো, তার ঠিক আগের দিন দেশের গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম ছিল 'শিক্ষা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশ'। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ওই বছর ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম।

এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সভিত্তিক বিজনেস স্কুল 'ইনসিয়েড' এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক 'পোর্টুল্যান্স ইনস্টিটিউট' যে 'গ্লোবাল ট্যালেন্ট কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স' প্রকাশ করে, সেখানেও ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৩তম। মেধা অর্জনের সক্ষমতা, আগ্রহ, বিকাশ, ধরে রাখা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি দক্ষতা ও বৈশ্বিক জ্ঞান—এই ৭টি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ওই সূচকটি তৈরি করা হয়। এই প্রতিভা সূচকেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার নিচে। অথচ, আমরা সব সময়ই এটি বলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগি যে বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা খুবই প্রতিভাবান। কিন্তু আন্তর্জাতিক সূচকে তার প্রতিফলন কেন নেই—সেটা বিরাট প্রশ্ন।

বিশ্বব্যাংকের মতো বিরাট প্রতিষ্ঠানের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিরাট অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে গর্বিত হওয়ার আনন্দ উদযাপন করলো, সেই আনন্দ ম্লান হয়ে যায় যখন শিক্ষা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশ অবস্থান করে। একইভাবে যে গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ—সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও বরাবর পিছিয়ে থাকা সম্মানজনক নয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সূচকের গুরুত্ব কী বা এইসব সূচকের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? সেই তর্ক করা যেতেই পারে। আবার এটাও ঠিক যে, আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠন যখন এই ধরনের সূচক তৈরি করে, সেখানে বড় ধরনের গবেষণা থাকে। বেশ কিছু মানদণ্ড থাকে। তাদেরকে অনেক জায়গায় জবাবদিহি করতে হয়। ফলে মনগড়া তথ্য দিয়ে সূচক বা প্রতিবেদন তৈরির সুযোগ নেই। অর্থাৎ বিতর্ক যতই থাকুক বা সরকার এইসব সূচক গ্রহণ করুক কিংবা না করুক, এর কিছু গুরুত্ব আছে।

এসব সূচকের মধ্য দিয়ে প্রতিটি দেশ সম্পর্কে অন্য দেশগুলো ধারণা পায়। মানব উন্নয়ন সূচক কিংবা অর্থনৈতিক সক্ষমতার নানা চ্যালেঞ্জ জয় করে বাংলাদেশ যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, সেটিও এই ধরনের সূচকের মধ্য দিয়েই আমরা জানতে পারি।

পক্ষান্তরে এ কথাও ঠিক, বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটা মুক্ত, কতটা স্বাধীন; বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ব্যবসার পরিবেশ কেমন—তা বোঝার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সূচক না হলেও চলে। মানুষ প্রতিনিয়ত নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এটি দেখতে পায়, বুঝতে পারে, জানতে পারে। অর্থাৎ, এগুলো ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশর মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচনের পরিস্থিতি কেমন—তা জানার জন্য কোনো বিদেশি সংস্থার কাছে না গেলেও চলে। মানুষ এগুলো জানে, বোঝে।

কিন্তু এখনো মানুষের অন্যতম ভরসার নাম গণমাধ্যম। যখন দেশের রাজনীতি বেহাত হয়ে যায়, রাষ্ট্রের সবকিছু ভেঙে পড়ে, সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়, বিপন্ন মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকে না—তখন গণমাধ্যমই হয় তার সবশেষ আশ্রয়।

মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, সাংবাদিকরা যদি তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন, তাহলে কেউ না কেউ ওই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবেন। এই বিশ্বাস এখনো মানুষের মনে আছে। নানা সংকটের পরেও, নানা সীমাবদ্ধতা ও বিতর্কের পরেও গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের এই আস্থাটি আছে। যদিও সেই আস্থার সংকটও আছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাষ্ট্র ও রাজনীতির চাপ, প্রশাসনিক চাপ, ডলার কামানোর জন্য অনলাইন মাধ্যমে চটুল সংবাদ ও শিরোনাম দেওয়াসহ নানা কারণেই গণমাধ্যমের পেশাদারি যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হলেও দিন শেষে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানার জন্য মানুষ ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, বরং গণমাধ্যমেই বিশ্বাস করতে চায়, আস্থা রাখতে চায়। সেই আস্থা ধরে রাখা বেশ কঠিন।

রাষ্ট্র ও রাজনীতি কখনোই গণমাধ্যমবান্ধব হয় না। ক্ষমতাবানরা সব সময়ই চায় তাকে চাপে রাখতে। ক্ষমতাবানরা চায় গণমাধ্যম শুধু তার প্রশংসা করবে। তার খারাপ ও অন্ধকার দিকগুলো আড়াল করে শুধু তার ভালো দিকগুলো তুলে ধরবে। যে কারণে ক্ষমতাবানরা সাংবাদিকদের পেলেই খুব সাধারণ একটি বাক্য আওড়ান, 'আপনারা শুধু আমাদের খারাপটাই দেখেন। ভালোটা দেখেন না।' অথচ এটিই স্বাভাবিক। একজন জনপ্রতিনিধি, একজন গণকর্মচারী, একজন রাজনীতিবিদ ভালো কাজ করবেন—এটিই তার দায়িত্ব। তিনি ভালো কাজ করছেন, সেটা বলার দায়িত্ব গণমাধ্যমের নয়। গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে, তাকে অনুসরণ করা, কোথায় বিচ্যুতি হচ্ছে সেটি তুলে ধরা।

ফলে নানা সংকট ও চাপের মধ্যেও গণমাধ্যম সেই কাজ কতটুকু করতে পারছে—সেটি বিরাট প্রশ্ন। গণমাধ্যম এই চাপ ও ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে কি না—সেটিই বিবেচ্য। বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ কোথায় থাকলো এই প্রশ্নের চেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেদের সংকটগুলো সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল এবং তারা আত্মসমালোচনা করতে পারছেন কি না।

সবাইকে মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের শুভেচ্ছা। গণমাধ্যম মুক্ত হোক সব ধরনের শৃঙ্খল থেকে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments