ঢাকার জেলেরা কী করে বাঁচবেন

‘নদী ভালো নাই। নদী ভালো না থাকলে আমরাও ভালো থাকি না। নদীতে মাছ না থাকলে আমাদের ঘরে খাবার থাকে না।’
ঢাকার জেলেদের জীবন
পেশা বদলে ফেলাই যেন জেলেপল্লীর মানুষগুলোর নিয়তি। ছবি: আমীন আল রশীদের সৌজন্যে

রাজধানীর গাবতলী সেতু পার হয়ে আমিনবাজারের ভেতর দিয়ে সরু গলি ধরে উত্তর দিকে হাঁটতে থাকলে কর্ণতলী নদীর ধারে শানবাঁধানো খেয়াঘাট; নাম বেগুনবাড়ি গুদারাঘাট। প্রশাসনিকভাবে এটি ঢাকার সাভার উপজেলার অন্তর্গত।

বছরের এই সময়টায় নদীতে পানি থাকে অনেক। ফলে শুকনো মৌসুমের মতো পানির রঙ কালো নয় এবং দুর্গন্ধও নেই। সেই সুযোগে অসংখ্য মানুষকে দেখা গেলো মনের আনন্দে গোসল করছেন। শানবাঁধানো ঘাট ও সিঁড়িতে খোশগল্পে মশগুল আরও অনেকে। ছোট ও মাঝারি আকারের বেশ কিছু নৌকা মানুষ পারাপার করছে।

ঘাটের ওপারেই বাগিচারটেকসহ আরও কয়েকটি গ্রাম—যেগুলো একসময় 'জেলেপল্লী' হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণতলী ও তুরাগে মাছ কমতে থাকায় জেলেরা এখন প্রান্তিক। উপরন্তু মৎস্যজীবী হিসেবে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতেও তারা নেই। ফলে পেশা বদলে ফেলাই যেন তাদের নিয়তি।

গত বছরের ২৩ মার্চ দ্য ডেইলি স্টার বাংলার একটি সংবাদ শিরোনাম 'নদী-খাল দূষণে পেশা ছেড়েছেন হাজারো জেলে'। খবরে বলা হয়, রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারের নয়ারহাট এলাকায় কলকারখানার তরল বর্জ্যে বংশী নদীর পানি দূষিত হওয়ায় এখন সেখানে আর মাছ পাওয়া যায় না। বছরের ১০ মাসই অন্য কাজ করতে হয় কিংবা বেকার থাকতে হয় সাভারের হাজারো জেলেকে। অথচ এক সময় তারা তুরাগ কর্ণতলী নদীতে মাছ ধরেই সংসার চালাতেন।

এই সংকট তুরাগ ও কর্ণতলী নদী তীরবর্তী প্রতিটি গ্রামেই। ভরা বর্ষার মৌসুমে নদীতে পানি বাড়লে এবং তার ফলে দূষণ কমলে এখন সামান্য কিছু মাছ পাওয়া যায়। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলে না।

কথা হয় বাগিচারটেক গ্রামের জেলে তপন রাজবংশীর সঙ্গে। কেমন আছেন? এ প্রশ্নের উত্তর: 'নদী ভালো নাই। নদী ভালো না থাকলে আমরাও ভালো থাকি না। নদীতে মাছ না থাকলে আমাদের ঘরে খাবার থাকে না।'

এরচেয়ে সহজ ভাষায় এরচেয়ে কঠিন কথা আর কী হতে পারে!

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণা বলছে, তুরাগ ও কর্ণতলী নদীর তীরে এখনো প্রায় ৪ হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে গাবতলী থেকে আশুলিয়া অঞ্চলের জেলেদের পরিচয় 'রাজবংশি' আর আশুলিয়া থেকে টাংগাইল অঞ্চলের জেলেরা 'বর্মণ'। কিছু মুসলমানও আছেন, যারা বেদে জনগোষ্ঠীর। সেইসঙ্গে বিরুলিয়া ও কড্ডা এলাকায়ও কিছু মুসলমান জেলের সন্ধান পাওয়া যায়।

নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় এবং বছরের অধিকাংশ সময় নদীর পানির রঙ কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত থাকায় এইসব অঞ্চলের জেলেদের বিরাট অংশই পেশা বদল করে ফেলেছেন। অনেকে সরাসরি মাছ ধরতে না পারলেও বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। কেউ আবার নৌকার মাঝি। কেউ ঢাকা শহর বা সাভার এলাকায় রিকশা চালান, মিস্ত্রির কাজ করেন, কেউ জোগালি।

জেলে পরিবারের নারীদের বিরাট অংশই এখন বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন। অনেকে হয়েছেন পোশাকশ্রমিক। অর্থাৎ নদীনির্ভর এই মানুষগুলো পেশা বদল করে যেসব কাজ করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন, সেগুলোকে তারা সম্মানজনক মনে করেন না। কারণ নদীর পানি ভালো থাকলে কোনো কোনোদিন ৫ হাজার টাকার মাছও ধরতে পারেন। এই উপার্জন তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদাবান করে। কিন্তু তারা যখন অন্য কোনো কাজ করতে বাধ্য হন, তখন নিজেকে শেকড়বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন।

তাদের সম্পর্ক নদীর সঙ্গে। নদীই তাদের জীবিকার উৎস। অর্থাৎ নদীর পানির ওপর নির্ভর করে তাদের বেঁচে থাকা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে নদীর তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য কল-কারখানা থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা, রাজধানীর নিকটবর্তী হওয়ায় নদী তীরের জায়গা ভরাট করে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত এবং আরও নানা কারণে একদিকে নদীর পানি ও স্রোত কমে যাওয়া এবং দূষণ বৃদ্ধির ফলে এই নদীগুলো এখন বিপন্ন। শুকনো মৌসুমের আগে কয়েক মাস নদীতে মোটামুটি পানি থাকলেও বছরের অন্য সময়ে নদীতে মাছ পাওয়া তো দূরে থাক, নদীর পানিতে হাতই দেওয়া যায় না। পঁচে দুর্গন্ধ ছড়ায়।

নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও রাজধানীর পাশের নদীগুলোর দূষণ কতটা কমেছে আর দখল কতটা বন্ধ হয়েছে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে আশার সংবাদ হলো, নদীর বিষয়ে সরকারকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিক ও সিরিয়াস বলে মনে হয়। দখলদারদের বিরুদ্ধে মোটামুটি সারা বছরই অভিযান চলে। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে পাড় বাঁধাই করে দেওয়ায় দখলের প্রবণতাও কিছুটা কমেছে। কিন্তু কল-কারখানাগুলোকে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনে বাধ্য করা যাচ্ছে না। ফলে অপরিশোধিত বর্জ্যের গন্তব্য শেষ পর্যন্ত নদী।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। অথচ এই নদীনির্ভর মানুষের সংকটই সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে রাজধানীর আশেপাশের নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল যারা, তাদের কষ্ট দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জেলেদের চেয়ে বেশি।

নদীর দখল ও দূষণের মাত্রা কত ভয়াবহ সেটি টের পাওয়া যায় ঢাকার একটু দূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে গেলে। তুরাগ, কর্ণতলী ও বুড়িগঙ্গার চেয়ে এই নদীটা কিছুটা দূরে। কিন্তু কারখানার বিষে নীল এই নদীটিও।

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম 'শীতলক্ষ্যায় মাছ নেই, জেলেদের দুর্দিন'। খবরের শুরুটা এরকম, শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ নেই। তাই মাছ শিকার করতে মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে যাচ্ছেন জেলেরা। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একরামপুর জেলেপাড়ার প্রবীণ জেলে হরিদাস বর্মণের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে, প্রায় ৫০ বছর ধরে মাছ শিকার করছেন এই বৃদ্ধ। শৈশবে বাবা-চাচাদের সঙ্গে দল বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ শিকারে যেতেন। কৈশোর-যৌবনেও বাড়ির পাশের শীতলক্ষ্যাই ছিল তার আয়ের একমাত্র উৎস। কিন্তু বার্ধক্যে এসে মাছের খোঁজে দূরের ধলেশ্বরী কিংবা মেঘনা নদীতে যেতে হচ্ছে তাকে।

বন্দর উপজেলার একরামপুর জেলেপাড়ায় একসময় ১২৫টি পরিবার সরাসরি মাছ ধরার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এখন টিকে আছে মাত্র ২টি। বাকিরা পেশা বদলে ফেলেছে। তুরাগ ও কর্ণতলী তীরের গ্রামগুলোর চিত্রও মোটামুটি একইরকম।

মৎস্যজীবীদের জন্য সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে, তাতেও বঞ্চিত রাজধানীর আশেপাশের এই জেলেরা। মৎস্যজীবী হিসেবে তাদের কোনো কার্ড নেই। ফলে কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান না। অর্থাৎ বংশ পরম্পরায় জেলে, মাছ শিকার ছাড়া যাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই, সেই প্রকৃত জেলেরাই সরকারি তালিকায় নিবন্ধিত হতে পারেননি। নিবন্ধন না থাকায় কোনো খাদ্য সহায়তাও তারা পান না।

নদী দখল ও দূষণের কারণে মাছ কমে যাওয়ায় ঢাকার আশেপাশের জেলেপল্লী কিংবা নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর মানুষের জীবিকার সংকট যেমন তীব্র হয়েছে, তেমনি এইসব জনপদে এখন বড় সংকট বিশুদ্ধ পানি। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে এই সংকট তীব্র হয়। পানি সংকটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য। পানিবাহিত নানাবিধ রোগ এইসব জনপদের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এখানে কোনো হাসপাতাল নেই। কেউ অসুস্থ হলে নদী পার হয়ে তাকে যেতে হয় ঢাকা কিংবা সাভারে। জেলেপল্লীর সন্তানদের পড়ালেখার সুযোগও সীমিত।

বিশুদ্ধ পানির জন্য এখানে ব্যক্তি ও বেসরকারিভাবে ছোট ছোট কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ে। কিন্তু সেটি প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। রাজধানীর অতি কাছে হওয়া সত্ত্বেও এইসব জনপদের মানুষ যে কতটা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এখানের মানুষেরা ভোটার। জনপ্রতিনিধিও আছেন। ফলে এমন নয় যে কেউ সমস্যাগুলো জানেন না। জানেন। কিন্তু সমাধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

সমাধান কী?

এই জনপদের মানুষ মনে করেন, নদী ভালো থাকলে তাদের সমস্যাগুলো এমনিতেই সমাধান হয়ে যেত। কারণ নদী ভালো থাকলে তাতে মাছ পাওয়া যেত। মাছ পাওয়া গেলে সংসারে সচ্ছলতা আসতো। অর্থাৎ আর্থিক কষ্ট না থাকলে অনেক সমস্যা মোকাবিলা করাই সহজ।

ফলে সারা বছর যেন তুরাগ ও কর্ণতলীতে পানির প্রবাহ থাকে; নদীর দখল ও দূষণ যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যায় এবং দখলকৃত অংশগুলোয় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নদীকে মুক্ত করা যায়; নদী দূষণ ঠেকাতে সব কলকারখানাকে ইটিপি স্থাপনে বাধ্য করা যায়—তাহলে অনেক সমস্যাই থাকে না।

সেইসঙ্গে রাজধানীর চারপাশে যেসব জেলে আছেন, তাদেরকে তালিকাভুক্ত করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনাটা জরুরি। এ জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে সুদৃষ্টি দিতে হবে। বিশুদ্ধ পানির সংকট সমাধানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও এগিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সংকট নিরসনে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি সংগঠনগুলোকে। না হলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীনির্ভর এই মানুষগুলো একসময় আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments