বিশ্ববিদ্যালয় কেন হয়ে উঠছে মাদক ও অপরাধের অভয়ারণ্য

এরিস্টটল, প্লেটো, সক্রেটিস—এই অনুক্রম আমাদেরকে বলে শিক্ষক যে মানের শিক্ষার্থী সেই মানেরই হবে।

ইউজিনিক্স মুভমেন্ট, ঔপনিবেশিক কাঠামো, কুলীন প্রথা, জাতপ্রথা, আশরাফ-আতরাফ—এসব সংস্কৃতির সূতিকাগার হয়ে উঠেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

বিকাশ সাধনের উপযুক্ত পরিবেশ, পরিচালনা পদ্ধতি, নৈতিক, দক্ষ ও যোগ্য মানুষের সমন্বয়ে যেকোনো প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে যায়। তার বদলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আশরাফ-আতরাফ তৈরি করে।

এক ধরণের জাতপ্রথা সচল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শিক্ষার্থীরাও জানে কোন কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রভাবশালী এবং তাদেরকে কেন্দ্র করেই শিক্ষার্থীরা তাদের পরিকল্পনা সাজায়, ছাত্ররাজনীতিও এগোয় একই ছকে। যে কারণে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন—শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকারী কর্তাব্যক্তি—তাদের অনৈতিক কাজকেও সয়ে যেতে চায় অধিকাংশ শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থী। কারণ, তাদের প্রতিবাদের ক্ষমতা নেই, বরং আছে সব হারানোর ভয়।

এই সুযোগকে সবসময়েই কাজে লাগায় অপরাধী চক্র। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ক্ষমতাশালী মানুষদের দীর্ঘদিন নজরে রাখে। তাদের মনের অবস্থা বুঝে তাদের সঙ্গে গড়ে তোলে সখ্যতা। যার বিনিময়ে তারা পেয়ে যায় সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস। তাদেরকে বলয় করেই গড়ে ওঠে ক্ষমতার সিন্ডিকেট।

এই সিন্ডিকেট দিনের বেলায় নানা দলীয়, গোত্রীয়, ধর্মীয় চেহারায় বিভক্ত থাকলেও রাতের বেলায় একই টেবিলে হাজির হয়। এই সিন্ডিকেটে শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর সঙ্গে অশিক্ষিত মানুষও সঙ্গী হতে পারে, যদি তাদের লভ্যাংশ ঠিক হয়।

এর আলামত আমরা গণমাধ্যমে নানান সময়ে দেখি। তারা জমিদখল, জমির ব্যবসা, মাদক, দেহব্যবসা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো সিন্ডিকেটে জড়ায়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সংস্কৃতিতে অপরাধীরা টিমওয়ার্কে তথা একটা চেইনকে ঘিরেই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

এমন ঘটনারই উদাহরণ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। এর মূল পরিকল্পনাকারী মামুন এসএসসি পাশ না করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাজনীতিতে সক্রিয় মোস্তাফিজের সুবাদে হলে অবস্থান করেন, শিক্ষার্থীদেরকে মাদক সিন্ডিকেটে যুক্ত করেন।

এমন ঘটনার সাক্ষী আমিও ছিলাম, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমাদের এক বিভাগীয় শিক্ষকের প্রজেক্টের দায়িত্বে এমন একজন ছিলেন, যাকে ঘিরে সব শিক্ষার্থী সুশোভিত থাকলেও পরবর্তীতে জানা যায় তিনি এইচএসসিও পাশ করেনি। পরে শুনেছি তিনি নাকি আমার ওই শিক্ষককেও ভিক্টিম করেছিলেন।

ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার কারণে এমন অনেকগুলো ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। দেখেছি, কীভাবে কিছু মানুষ ক্যাম্পাসের কোনো স্টেকহোল্ডার না হয়েও ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা গবেষণা করতে চান কিন্তু ক্ষমতা চর্চার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না, তাদের পদে পদে বিপদ হওয়ার ভয় থাকে। যেখানে কিনা ব্যক্তিকে বন্ধুবিহীন পথচলার শঙ্কা নিয়েই এগোতে হয়। শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে থিসিস করতে চান না।

অপরদিকে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেন, তারা সাতখুন মাফের পর্যায়ে থাকেন। কোনো ভয়-ডর তাদেরকে স্পর্শ করে না। বিরোধী শিবিরের লোকেরাও দিনশেষে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখে। শিক্ষার্থীরাও সেলফি তুলে, জন্মদিনে কেক কেটে কিংবা নানা বস্তু ও অবস্তুগত নিদর্শনের মধ্য দিয়ে তাদের ভালোবাসা প্রদর্শন করেন।

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এমন গুটিকয়েক মানুষই হয়ে ওঠেন পুরো ক্যাম্পাসের ভাগ্যবিধাতা। তাদের মধ্যে কেউ শিক্ষক, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ কর্মকর্তা, কেউবা কর্মচারী। যদি কখনো সেই ক্ষমতায় টানাপোড়েন চলে তখনই কেবল আমজনতা, সাংবাদিক, সুশীলমহল অবগত হওয়ার সুযোগ পান। নয়তো অন্ধকারে কখনো বা ওপেনসিক্রেট হিসেবে চলে ক্ষমতার লড়াই। পাঠের চেয়ে মাঠের খবরা-খবর নিয়েই তাদের গবেষণারত থাকতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের স্ক্রিনশট, তাদের সর্বশেষ আপডেট, কোন কোন পোস্টে লাইক দিয়েছেন, কমেন্ট করেছেন সেগুলো নিয়ে তারা গবেষণায় ব্যস্ত থাকেন। কাজ করতে গিয়ে কে কোথায় ভুল করেছে, সে বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তাকে সে বিষয়ে পথে, ঘাটে, অনলাইনে কখনো বা অফলাইনে কৈফিয়ত তলব করা হয়।

এতে করে একটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল কাজে এক ধরণের স্থবিরতা বিরাজমান।

মিডিয়ার কল্যাণে দেশ ও দশের মানুষ শুধু জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হওয়ার কাহিনী। কিন্তু তাদের অজানা থেকে যায় অনেক সাধারণ শিক্ষকের মানবেতর জীবনযাপনের কথা।

তারা এমনটি একা একা সয়ে গেলেও খুব একটা মানুষকে জানাতে চান না নানান কারণেই। কখনো তারা আবার জুলুমের খড়গহস্তের ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষার্থীরা গণরুমে থাকেন না। অনেক শিক্ষককে গণরুমের মতো একটা কক্ষে ৫-৬ জনকে শেয়ার করে থাকতে হয়। সেমিনার কিংবা লাইব্রেরিতে থাকে না পর্যাপ্ত গবেষণার বই, প্রবন্ধ ও উপকরণ। অথচ থাকে ৫-৬টি নিয়মিত কোর্সের চাপ। থাকে ভালো প্রকাশনায় নিবন্ধ প্রকাশের চাপ।

এর বাইরে তাকে আবার হাজিরা দিতে হয় ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী জোটের সঙ্গে। হাল আমলে গড়ে ওঠা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যাবে এমন চিত্র। একজন সাধারণ শিক্ষক যতটা না চিন্তা করতে পারেন তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে, তাদের কাছ থেকে শেখা ও শেখানোর বিষয় নিয়ে, নিজের গবেষণা নিয়ে, তার চেয়ে বরং তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় নিজের অধিকার, সম্মান, জুলুমের শিকার হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে। যে কারণে দেখা যায়, যখন কোনো শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যান, তাদের অধিকাংশ আর ফিরে আসতে চান না।

বিদ্যমান এই সিস্টেমের পরিবর্তন জরুরি। বিশেষ করে নতুন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর তাদের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আশরাফ-আতরাফের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে সাম্যের সংস্কৃতি হওয়া দরকার। পদের কারণে, বুদ্ধি ও শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে পদমর্যাদা আলাদা হলেও প্রত্যেকেই মানুষ—হোক সে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী।

প্রত্যেকের দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভালোকে ভালো বলার ও খারাপকে খারাপ বলার মৌলিক অধিকার চর্চার সুযোগ অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা দরকার। আবাসিক হলের নিয়ন্ত্রণ নির্দিষ্ট কারো হাতে না দিয়ে প্রশাসনের উচিত নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের সমস্যা ও সংকট সমাধানে নিয়মিতভাবে সেবা প্রদান। প্রত্যেকে নিজেদের সমস্যা যেন মন খুলে প্রশাসনকে জানাতে পারে, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যেন দ্রুত সমাধান পায়।

বিশেষ করে আমাদের হলগুলোতে একাডেমিক সংস্কৃতি চালু করা দরকার। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বই, ইলেকট্রিক ডিভাইস, হলভিত্তিক একাডেমিক পুরস্কার, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত নির্দেশনা ও বাস্তবায়নে তৎপরতা দরকার। একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে যে বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে সেসব বিষয় নিয়েও কাজ করা দরকার।

সবকিছুর আগে দরকার বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নামে না হয়ে এর উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই যেন মানসিক প্রশান্তি নিয়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও জ্ঞান আদান-প্রদান করতে পারে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

আরবিতে জামেয়া মানে বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কওমি মাদরাসায় দেখবেন জামেয়া লেখা। সাইনবোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয় লেখা থাকলেও ভেতরের পরিবেশ, জায়গার পরিধি দেখলে বোঝা যাবে সেই জামেয়াগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় মানের। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাও অনুরূপ। বরং কোনো অংশে তারচেয়েও ভয়াবহ।

জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চিত করার চেয়ে আমাদের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে সেগুলোর মান ও পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে উপযুক্ত পরিবেশে যখন যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি রাষ্ট্র অনুভব করবে, তাদের নিয়োগ নীতিতে সেটা থাকবে, জ্ঞানে ও মানে নিজেদের উজাড় করে দেওয়া শিক্ষার্থীরা যখন এই পেশায় সহজেই আসতে পারবে, তখনই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস ও মাদকের বদলে গবেষক পাবো, মাস্তানি সংস্কৃতির বদলে মাস্টারি সংস্কৃতি পাবো।

এরিস্টটল, প্লেটো, সক্রেটিস—এই অনুক্রম আমাদেরকে বলে শিক্ষক যে মানের শিক্ষার্থী সেই মানেরই হবে। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের জন্য সুশৃঙ্খল নীতিমালা, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের সমন্বয়েই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত মানুষ তৈরি করতে পারবে। নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাদক ও অপরাধের অভয়ারণ্য হয়েই থাকবে।

 

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

Email: [email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments