মানুষ আর কতভাবে মরবে!

আদরের ছোট দুই সন্তান আর স্ত্রীকে মেরে নিজে মরার আগে রাজশাহীর মিনারুল ইসলাম চিরকুটে সবার 'দায়মুক্তি' নিশ্চিত করে গেছেন। লিখেছেন, তাদের এই মৃত্যুর জন্য কারও কোনো 'দোষ' নেই।
তবে চিরকুটে মিনারুল এ কথা জানাতেও ভোলেননি যে, তারা মরেছেন কিংবা মরতে বাধ্য হয়েছেন 'ঋণের দায়ে আর খাবারের অভাবে'।
বর্ষায় কাজ ছিল না ঋণগ্রস্ত মিনারুলের। বউ-বাচ্চার জন্য খাবার জোটাতে না পারা মানুষটির মাথার ওপর ছিল সপ্তাহে ২ হাজার ৭০০ টাকার কিস্তি পরিশোধের চাপ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চেয়ে খাওয়ার গ্লানি আর ছোট হয়ে থাকার লজ্জা। কেবল নিজে মরে স্ত্রী-সন্তানদের সেই লজ্জার ভেতর, সেই গ্লানির ভেতর রেখে যেতে চাননি এ যুবক। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়েই নিষ্ঠুর এই পৃথিবী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
একইদিন গত শুক্রবার হৃদয়বিদারক আরেকটি ঘটনা ঘটে শরীয়তপুর শহরে। সেখান থেকে মুমূর্ষু এক নবজাতককে নিয়ে ঢাকাগামী অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেন শরীয়তপুর সিভিল সার্জনের গাড়ির চালক আবু তাহের দেওয়ান ও তার ছেলে সবুজ দেওয়ান। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা আটকে থাকার পর অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই মৃত্যু হয় নবজাতকের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানে দীর্ঘদিন ধরেই অ্যাম্বুলেন্স মালিক-চালক সিন্ডিকেটের কবলে ভুগছেন সাধারণ রোগীরা। এ সিন্ডিকেটের কারণে জেলার বাইরে থেকে গাড়ি এসে রোগী নিতে পারে না। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত খরচে সিন্ডিকেটের গাড়ি ভাড়া করতে হয়। বাইরের গাড়ি রোগী নিতে হলে এ সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হয়।
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হিসেবে সামনে এসেছে মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) তৈরি করে সহিংসতা। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদের নামে মব তৈরি করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা, লুট, কাউকে জিম্মি করে চাঁদাবাজি, মামলা ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মব-সহিংসতা ও গণপিটুনির অন্তত ১৭৩টি ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭৯ জন ও আহত হয়েছেন অন্তত ১৫৮ জন।
সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে দুই নিরপরাধ মানুষ—রূপলাল দাস (৪০) ও ভ্যানচালক প্রদীপ লালকে (৩৫) গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলেও 'মবের ভয়ে' তাদের উদ্ধার না করে ফিরে যায়। ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই একজন মারা যান। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান অন্যজনও।
পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাব অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন জুন মাসে।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর এক বছর পার হলেও অপরাধ কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ইন্টেরিম।
পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাব অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৯৩০ জন খুন হয়েছেন। সর্বোচ্চ ৩৪৩ জন খুন হয়েছেন জুন মাসে।
সড়কে মৃত্যুর মিছিলও থেমে নেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, গত জুলাইয়ে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে ৫৫৪টি দুর্ঘটনায় ৫৬৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪১১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সড়কপথেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। সড়কপথের ৫০৬ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫২০ জন ও আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৫৬ জন।
গত জুলাইয়ে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনের সামনে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ–৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে থাকে শিশুরা। এই মর্মান্তিক ঘটনা সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের নিরাপত্তাকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা ও মানবিক প্রতিক্রিয়ার দুর্বল দিকগুলো।
ওই মাসেই গাজীপুরের টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায় নালায় পড়ে ফারিয়া তাসনিম ওরফে জ্যোতি (৩২) নামের এক নারী নিখোঁজ হন। এর ৩৬ ঘণ্টা পর টঙ্গীর শালিকচূড়া বিল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এতিম হয়ে যায় জ্যোতির ছয় বছরের যমজ সন্তান।
প্রশ্ন হলো—২০ কোটি জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডে আর কতভাবে মানুষের মৃত্যু হতে পারে? অস্বাভাবিক মৃত্যুকেই কি এখানকার সবচেয়ে সস্তা ও নিশ্চিত অনুষঙ্গ ধরে নেব আমরা?
ঋণের টাকা শুধতে না পেরে, অপরের কাছে হাত পাতার গ্লানি ঘোচাতে সপরিবারে আত্মহননেন পথ বেছে নেওয়া রাজশাহীর মিনারুল তো চিরকুট লিখে আমাদের দায়মুক্তি দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাকি মৃত্যুগুলোর দায় কে নেবে?
এ দেশে উপর থেকে ইট কিংবা নির্মাণসামগ্রী পড়ে পথচলতি মানুষের মৃত্যু হরহামেশাই খবর হয় গণমাধ্যমে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গ্যাসের সিলিন্ডার অথবা কেমিক্যালের গুদামে বিস্ফোরণ, কিংবা ছুটে আসা রাজনীতির গুলিতেও অনেক সাধের জীবন উড়ে যায়। আবার জতুগৃহ হয়ে ওঠা নগর-মহানগরগুলোয় পুড়ে মরার ঘটনাও খুব স্বাভাবিক। পাহাড় ধস, ভবন ধস, নৌকা-ট্রলারডুবিতে মৃত্যুও এখানে নিত্যকার ঘটনা।
ঋণের টাকা শুধতে না পেরে, অপরের কাছে হাত পাতার গ্লানি ঘোচাতে সপরিবারে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া রাজশাহীর মিনারুল তো চিরকুট লিখে আমাদের দায়মুক্তি দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাকি মৃত্যুগুলোর দায় কে নেবে?
তাহলে কি ২০২৪–এর রক্তক্ষয়ী জুলাই যে 'নতুন ব্যবস্থার' স্বপ্ন নিয়ে হাঁটছিল, সেই স্বপ্নও মুখ থু্বড়ে পড়ল এক বছরেই?
তবে কি এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, এই রক্তে ভেজা সবুজ প্রান্তর মৃত্যু উপত্যকাই থেকে যাবে?
Comments