ঘুষ ও দুর্নীতি: পুরোনো সিস্টেমে নতুন বন্দোবস্ত!

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর গত প্রায় এক বছর ধরে যেসব শব্দ রাজনীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তার মধ্যে আছে 'নতুন বাংলাদেশ' ও 'নতুন বন্দোবস্ত'। অর্থাৎ ৫ আগস্টের আগে যেভাবে দেশ চলেছে, এখন আর সেভাবে চলবে না; রাষ্ট্রের সর্বত্র একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে—সেটা হোক রাজনীতিতে কিংবা প্রশাসনে, এই ছিল প্রতীতি।
কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কোথায় কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেবা নিতে গিয়ে মানুষের ঘুষ ও হয়রানির পরিমাণ কতটা কমেছে? তারচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘুষ ও দুর্নীতি কতটা বেড়েছে?
গত ২৬ জুলাই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে একজন ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে বলেন, 'আগে ঘুষ দিতে হতো এক লাখ টাকা, এখন দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা।' তিনি বলেন, দেশের কোথাও কোনো সুশাসন ও নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশেও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিনি এই মন্তব্য যেদিন করেন, সেদিন রাতেই রাজধানীর গুলশান এলাকায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজি করার অভিযোগে আটক হন পাঁচজন। তাদের একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক কমিটির নেতা রিয়াদ।
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দুই সপ্তাহের মাথায় ২১ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেউ ঘুষ চাইলে তাকে ঘুষি মারুন। অর্থাৎ তিনি ঘুষখোরদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান।
যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরে এর নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অনেক নেতার বিরুদ্ধেই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে মব সৃষ্টি করে দখল, ফ্যাসিস্ট অথবা বিগত সরকার ও আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ অভিযোগ তুলে চাঁদা আদায় ও হামলার মতো অভিযোগ উঠেছে 'নতুন বাংলাদেশ' গড়ার স্লোগান দেওয়া এই তরুণদের বিরুদ্ধে। যে কারণে অনেকেই এটিকে বলছেন পুরোনো সিস্টেমে নতুন বন্দোবস্ত।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে হাসনাত বলেছিলেন, যারা চাকরি করছেন, আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাই বিগত সরকারের সময় যে ধরনের শাস্তি হতো—মৃদু তিরস্কার অথবা ওএসডি—এগুলো কোনো শাস্তি নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে। প্রয়োজনে বিদ্যমান যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তার মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবো। যা করার প্রয়োজন তাই করে এই ঘুষের যে বাণিজ্য রয়েছে, দুর্নীতির যে আখড়া রয়েছে, সেটিকে ছাত্র-নাগরিকরা সমূলে উৎপাটন করবে।
কিন্তু এর প্রায় এক বছর পরে বিএনপি মহাসচিবকে বলতে হলো, ঘুষের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার কোথায় কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন আনলো বা আনতে পারলো? সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত না হোক, অন্তত সহজ করবে—এমন কী কী পদক্ষেপ এই সরকার নিয়েছে?
সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় সরকারি অফিসগুলোয় সেবা নিতে গিয়ে। যারা সেবা দেওয়ার দায়িত্বে থাকেন, আইনের ভাষায় তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আর সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। অতএব সরকারি কর্মচারীরা প্রকারান্তরে জনগণের কর্মচারী। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।' কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রজাতন্ত্রের এই কর্মী বা কর্মচারীরা সেবাগ্রহীতা জনগণকেই তাদের অধীনস্থ মনে করেন এবং জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হলেও ওই জনগণকে সেবা দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেওয়াটাকে তাদের অধিকার বলে মনে করেন। এই মনে করাটা ৫ আগস্টের আগে যেমন ছিল, এখনও তাই আছে। কোথাও যে ন্যূনতম কোনো পরিবর্তন হয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে বলার সুযোগ নেই।
মির্জা ফখরুল যেদিন বললেন ঘুষের রেট পাঁচগুণ বেড়েছে, তার পরদিন একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়, হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা দপ্তরে ঘুষের পরিমাণ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে ভূমি, বিচারিক সেবা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বন্দর পরিষেবা, সচিবালয়ে ফাইল ছাড়ানো এবং বিআরটিএ অফিসে ঘুষের হার বেড়েছে অন্তত ৫ গুণ।
বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাষ্ট্রীয় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে যে ধরনের পদক্ষেপ ও অগ্রগতির প্রত্যাশা করা হয়েছিল, সেটি ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। জাতীয় নির্বাচন, জুলাই সনদ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে এত বেশি এজেন্ডা সামনে আসছে যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নাগরিক হয়রানি ও ভোগান্তি নির্মূলের বিষয়টি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। হয়তো এটি সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায়ও নেই।
২.
রাষ্ট্রীয় যেসব প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও আর্থিক দুর্নীতির শিকার হয়, পুলিশ প্রশাসন তার অন্যতম।
প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের পরে পুলিশের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে কি আদৌ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? এখন কি থানায় সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে, বিনা ঘুষ ও হয়রানি এবং সময়ক্ষেপণ ছাড়াই সেবা পাচ্ছে? পুলিশ কি দুর্নীতি বন্ধ করেছে? পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন এই বাহিনীকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবে?
বলা হয়, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সব জায়গায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে যে দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছিল, সেই চক্র তো ভাঙেইনি, বরং কোথাও কোথাও এই চক্র আরও শক্তিশালী হয়েছে। তাহলে নতুন বাংলাদেশ ও নতুন বন্দোবস্তের বুলি আওড়িয়ে লাভ কী?
জনমনে এই প্রশ্নও রয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের গত প্রায় এক বছরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধু ও শেখ পরিবারের লোকদের নাম বাদ দেওয়া ছাড়া আর কী কী দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ ও উন্নত করবে? যে নতুন বাংলাদেশ ও নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা হচ্ছে শুরু থেকে, সেই নতুনত্ব কোথায়? শুধু চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও ঘুষ গ্রহণকারীর রাজনৈতিক ও ব্যক্তি পরিচয় বদলেই নতুনত্ব?
২৭ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) একটি প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম প্রকল্পের কেনাকাটার প্রক্রিয়া আটকে দেন। দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থাও করেন। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শেষ হওয়ার আগেই এখন সেই প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনার তোড়জোড় করছেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তার বিরুদ্ধে দুদককে প্রভাবিত করার অভিযোগও উঠেছে। অনুসন্ধান চলার মধ্যেই যাতে কেনাকাটা করা যায়, সেজন্য দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছেন ফয়েজ আহমদ। তার বিরুদ্ধে এই প্রকল্পে কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
এই সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে এনসিটিবিতে কাগজ সরবরাহে ৪০০ কোটি টাকা কমিশন নেওয়ার অভিযোগ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ডিসি নিয়োগে তদবিরসহ নানা অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এ ছাড়া, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সাবেক দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবী ও ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও তদবির বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। তাদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। এসব ঘটনায় অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রসিকতা করে লিখেছেন, আগে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হতে লাগতো ১৫ বছর, এখন লাগে তিন মাস!
পরিশেষে, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, উপদেষ্টাদের কর্মকর্তা ও নতুন বাংলাদেশ শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করে যে এনসিপি, তাদের নেতাদের বিরুদ্ধেই যদি এই ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে; অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা লোকজন কিংবা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারণেই যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments