১৪ জন মানুষকে হত্যার শাস্তি ৫ বছরের জেল!

সরকার চাইলেও এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ প্রতিটি সরকারই বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করার জন্য এই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরকেই কাজে লাগায়। যার কাছ থেকে আপনি অন্যায্য সুবিধা নেবেন, তার অনেক অন্যায়ও আপনাকে হজম করতে হবে।

মহাসড়ক মানেই এখন হত্যার মহাযজ্ঞ। গত ১৬ এপ্রিল ফরিদপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হওয়ার রেশ না কাটতেই এর ঠিক পরদিন ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্তে গাবখান চ্যানেলের ওপর নির্মিত পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর টোল প্লাজায় বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ গেছে প্রাইভেট কার ও অটোরিকশার অন্তত ১৪ যাত্রীর। আরও অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন—ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

সড়কে বড় কোনো প্রাণহানির পরে যে বিষয়গুলো জানা যায় তার মধ্যে আছে, বাসের ফিটনেস ছিল না, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না, চালকের হালকা যানবাহন চালানোর লাইসেন্স থাকলেও ট্রাক বা বাসের মতো ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স ছিল না, যিনি ট্রাক বা বাসটি চালাচ্ছিলেন তিনি চালকের বদলে চালাচ্ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঝালকাঠিতে প্রাণহানির জন্য দায়ী বাসচালককে আটকের পরেও জানা গেছে, আল আমিন নামে যিনি ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন, তিনি ওই ট্রাকের মূল চালক নন। বদলি হিসেবে ট্রাক চালাচ্ছিলেন এবং তার ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই।

পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে আল আমিন জানিয়েছেন, খুলনা থেকে ট্রাকে সিমেন্টের বস্তা উঠিয়ে তিনি নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন এবং এই গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা তার ছিল না। তার হালকা যান চালানোর লাইসেন্স ছিল। ঘটনার সময় ব্রেকফেল হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি দাবি করেন।

প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে যেসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়, বস্তুত এর অধিকাংশই হত্যাকাণ্ড। আরেকটু খোলাসা করে বললে 'সিস্টেম্যাটিক হত্যাকাণ্ড'। কেননা, দুর্ঘটনা বললে সেখানে কাউকে দায়ী করা যায় না। এটা অনেকটা নিয়তিনির্ভর।

ধরা যাক, আপনি নিয়ম-কানুন মেনে রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন। সড়কটিও ত্রুটিমুক্ত। আপনার গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে, নিবন্ধন আছে এবং গাড়ি চালানোর জন্য আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো, কিংবা কুয়াশায় পথঘাট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না বলে আপনার গাড়িটা রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেলো। এটি দুর্ঘটনা। অথবা আপনার দ্রুতগতির গাড়ির সামনে দিয়ে হঠাৎ একটি কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী দৌড় দিলো এবং আপনি তাকে বাঁচাতে গিয়ে অথবা নিজেকে সুরক্ষিত করতে গিয়ে রাস্তার পাশের খাদে নামিয়ে দিতে বাধ্য হলেন কিংবা গাড়ির ব্রেক ফেল করলো। এটিও দুর্ঘটনা।

কিন্তু আপনি নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ির ফিটনেস আছে, আবহাওয়া ভালো, সড়কেও ত্রুটি নেই। বিপরীত দিক থেকে অথবা পেছন থেকে আরেকটা গাড়ি এসে আপনাকে সজোরে ধাক্কা দিলো। যে গাড়িটি আপনাকে ধাক্কা দিলো, সেই গাড়ির চালকের বেপরোয়া আচরণে আপনার জীবন বিপন্ন হলো। পরে জানা গেলো, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়ির চালকের লাইসেন্সও ছিল না। তিনি গাড়ি চালানোয় দক্ষ নন। হতে পারে যে তিনি মদ্যপও ছিলেন। তাহলে এটি কি দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকাণ্ড? এই ঘটনার জন্য ওই চালকের কী শাস্তি হওয়া উচিত?

সুতরাং, কোনটি দুর্ঘটনা আর কোনটি হত্যাকাণ্ড, সেটি আগে পরিষ্কার হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের বিদ্যমান আইনে সেটি পরিষ্কার করা হয়নি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব আন্দোলনের ফলে একটি আইন হলো। কিন্তু তার নাম দেওয়া হলো 'সড়ক পরিবহন আইন'। সেখানে 'নিরাপত্তা' কথাটিই নেই। অথচ নাগরিক সমাজের দাবি ছিল, আইনটির নাম হবে 'সড়ক নিরাপত্তা আইন।'

পরিবহন মাফিয়াদের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। উপরন্তু চালকের খামখেয়ালি ও বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা এবং অনুমোদনহীনভাবে গাড়ি চালানোর জন্য কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে সেটিকে হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করে যাতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়—সেই দাবিটিও আমলে নেওয়া হয়নি।

বরং সড়ক পরিবহন আইনের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হইলে বা তাহার প্রাণহানি ঘটিলে, উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড, বা অনধিক ০৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।'

তার মানে ঝালকাঠিতে ট্রাকচালকের বেপরোয়া আচরণে যে ১৪ জন মানুষের প্রাণ গেলো, সেই ঘটনায় ওই চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে পাঁচ বছরের জেল! তাও যদি সঠিক বিচার হয়। অথচ এই ট্রাকচালকই যদি ছুরি দিয়ে একজন মানুষকেও খুন করতেন এবং আদালতে যদি তার অপরাধ প্রমাণিত হতো, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হতো। কিন্তু শুধুমাত্র আইনি দুর্বলতার কারণে তিনি ১৪-১৫ জন মানুষকে হত্যা করেও পাঁচ বছরের বেশি জেল খাটবেন না।

সড়ক মহাসড়কে কেন প্রাণহানি থামছে না—তার অনেকগুলো কারণ আছে। কিছু দুর্ঘটনা সত্যিই দুর্ঘটনা। অর্থাৎ যে ঘটনার জন্য চালক দায়ী নন। কিন্তু অধিকাংশ প্রাণহানির পেছনেই থাকে চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা।

কাদের হাতে আমরা গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দিচ্ছি? তার ভেতরে জীবনকে ভালোবাসার অনুভূতি আর মানবিকতাবোধ কতখানি আছে? চলন্ত পথে যার হাতে আমাদের জীবন; গণপরিবহনের যে চালকেরা আমাদের নিয়ে যান মাইলের পর মাইল; গভীর রাতে ফাঁকা মহাসড়কের যে চালক অর্ধশত মানুষকে বহন করে নিয়ে যান, তার দায়িত্ববোধ, মানবিকতাবোধ কতটুকু আছে, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ কতটুকু আছে, সেই হিসাব আমরা কখনও করেছি কি না? এতগুলো মানুষের জীবন যার হাতে, সেই মানুষটিকে জীবন ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে কখনও জ্ঞান দেওয়া হয়েছে কি না? সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এই চালকদের জীবনের মূল্য ও মানবিক মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন করেছে কি না? বিআরটিএর লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় কি তার মানসিকতা, জীবনবোধ ও অন্যের জীবনের প্রতি দায় নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়? পরীক্ষা নেওয়া হয়?

বিশেষ করে বাস ও ট্রাকচালকদের অধিকাংশেরই যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কম এবং তাদের বিরাট অংশই যেহেতু আসেন সমাজের প্রান্তিক, পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত পরিবার থেকে, ফলে তাদের বেড়ে ওঠার মধ্যেই যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তার পক্ষে নিয়ম-কানুন মেনে এবং মানুষের জীবনকে মূল্য দিয়ে গাড়ি চালানো আদৌ সম্ভব কি না?

পরিবহন খাতের বিদ্যমান 'যত ট্রিপ তত পয়সা' পদ্ধতির কারণে চালকদের মধ্যে যে বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা গড়ে ওঠে—সেটিও সড়ক অনিরাপদ করে তোলার একটি বড় কারণ। অথচ সড়ক পরিবহন আইনে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই। যতটুকু আছে, তাও মানা হয় না। বরং অপরাধ প্রমাণিত হলেও বড় কোনো শাস্তি হবে না—এই আত্মবিশ্বাসও সড়ক নিরাপদ করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

তার সঙ্গে আছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ঐক্য—যে ঐক্যের কারণে সরকার যখনই সড়ক নিরাপত্তায় কোনো কঠোর আইন বা নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়, সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি আসে।

আবার সরকার চাইলেও এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ প্রতিটি সরকারই বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করার জন্য এই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরকেই কাজে লাগায়। যার কাছ থেকে আপনি অন্যায্য সুবিধা নেবেন, তার অনেক অন্যায়ও আপনাকে হজম করতে হবে।

দেশের পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না ফেরার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সব আমলে সব সরকারই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত এই খাত থেকে যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা তোলা হয়, তার ভাগ রাষ্ট্রের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়, সেটি অনেকেই জানেন।

তার মানে সরকার-সরকারি দল-পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা যখন অভিন্ন স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত—সেখানে সাধারণ মানুষের জীবন সুরক্ষিত থাকবে সেটি খুব কঠিন। তাছাড়া পরিবহন মাফিয়াদের কারণে যে দেশে একটি কঠোর আইন পর্যন্ত করা যায় না—সেই দেশের সড়কে মানুষের জীবন নিরাপদ হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments