সমঝোতা স্মারক সংশোধনই হতে পারে সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর ব্যবস্থা

ঢাকা ও কুয়ালালামপুরে ক্ষমতার বলয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তের অংশ হিসেবে ধারাটি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকের অন্য ১৪টি উৎসদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বিধান নেই।

বাংলাদেশের স্বল্পদক্ষ কর্মীরা মালয়েশিয়ার নির্মাণ, উৎপাদন, চাষাবাদ ও সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা মালয়েশিয়ায় নিয়োগকর্তাদের আস্থা অর্জন করেছেন। ফলে বাংলাদেশ থেকে আরও শ্রমিক নিয়োগ করতে ইচ্ছুক মালয়েশিয়া। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে দেশটির শ্রমবাজার এ বছরের মে থেকে বন্ধ রয়েছে।

মালয়েশিয়ায় তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশি কর্মীদের একটি অংশ, যাদের অনেকেই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর সে দেশে গিয়েছেন, তাদেরকে উচ্চ অভিবাসন ব্যয় বহন করতে হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার নির্ধারিত ৭৯ হাজার টাকার বদলে তাদের গড়ে পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয় বাবদ খরচ করতে হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয়ের এই ব্যাপক বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে, কর্মী পাঠানোর জন্য কোন বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করবে, তা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের ওপরই অর্পণ করা হয়েছে।

২০২২ সালের জুলাইয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রবাহ পুনরায় শুরু হওয়ার পর অপ্রাতিষ্ঠানিক এ সিন্ডিকেট ব্যবস্থার অধীনে বাংলাদেশের এক হাজার ৫২০টি নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মাত্র ২৫টি অনুমতি পেয়েছিল। পরে সংখ্যাটি বাড়িয়ে ১০০ করা হয়। রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচনের জন্য কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ না হওয়ায় অনেক নতুন লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থা (যা রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে অনুমোদন পেয়েছিল) এ ব্যবস্থার সুবিধাভোগী হয়েছে।

চলতি বছরের আগস্টে স্বৈরশাসনের পতনের পর বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বেশ কয়েকজন সাবেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে পরিচালিত এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠানোর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

আরও অভিযোগ উঠছে, সিন্ডিকেটটি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন দাতোর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের জন্য এ সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকেই মূলত দায়ী করা হয়ে থাকে। এ দুই দেশের সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকারও অভিযোগ উঠেছে। ভেরিটি নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়ামের গবেষণায় দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় যাওয়া ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী উচ্চ ঋণ ও শোষণের শিকার হচ্ছে।

সিন্ডিকেট ব্যবস্থা মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত বিষয়। ২০২২ সালের জুনে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম দুটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল বেস্টিনেট—এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা চালু করার অভিযোগ আছে। তিনি সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

আনোয়ার ইব্রাহিম এটিকে 'আধুনিক দাসত্ব' হিসেবে উল্লেখ করেন, যেখানে কর্মীদের ব্ল্যাকমেইল করা হয় এবং ব্যবসায়ীরা ও সংস্থাগুলো নিপীড়নের মাধ্যমে বিশাল লাভ অর্জন করে।

২০২৩ সালের এপ্রিলে মালয়েশিয়ার ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির নেতা চার্লস সান্তিয়াগো সরকারের প্রতি বেস্টিনেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে শ্রম দালালদের নির্মূল করার আহ্বান জানান। তিনি উভয় দেশের জন্য একটি উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার দাবি জানান। ২০২২ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিম ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় তদন্তের আওতায় আসে এবং মন্ত্রণালয়ের পাঁচ কর্মকর্তা বরখাস্ত হন।

নতুন প্রধানমন্ত্রী অভিবাসীকর্মী নিয়োগ, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক সংগ্রহ ব্যবস্থাকে সংস্কার করার সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তার নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ কিছু রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক এলিটের একটি অংশের কঠোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। বেস্টিনেটের মালিকানাধীন আইটি সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনের চেষ্টা এখন পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হয়ে আছে।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া—উভয় দেশকেই সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। একটি সম্ভাব্য সমাধান হলো—বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে শ্রম নিয়োগ সংক্রান্ত সই হওয়া সমঝোতা স্মারক চুক্তির একটি ধারার সংশোধন। স্মারক চুক্তিটির গ (৫) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, 'মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো (বিআরএ) নির্বাচন করবে... বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত তালিকা থেকে।'

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকা ও কুয়ালালামপুরে ক্ষমতার বলয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তের অংশ হিসেবে ধারাটি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এটি লক্ষণীয় যে, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকের অন্য ১৪টি উৎসদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো বিধান নেই।

যদি এ ধারাটি সংশোধন করে মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের কাছে বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচন করার দায়িত্ব স্থানান্তরিত করা হয় (যা অন্যান্য উৎসদেশের ক্ষেত্রেও ঘটে), তাহলে নিয়োগকর্তারা তাদের সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো নির্বাচন করার স্বাধীনতা পাবে এবং বাংলাদেশে সব রিক্রুটিং এজেন্সি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশের জন্য সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে। এ ধরনের একটি ব্যবস্থা ন্যায্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে, অভিবাসনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাবে এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করবে, যেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল ভোগ করতে পারবে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তার দেশে অভিবাসী শ্রমিকরা যেন আধুনিক দাসত্ব ব্যবস্থার অধীনে না থাকে তা নিশ্চিত করার অভিপ্রায় সম্প্রতি তার সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফরে এসে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি শ্রমিকদের উচ্চ অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। এ জন্য সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভাঙা একটি পূর্বশর্ত হিসেবে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকে একটি সংশোধনী এনেই তা করা সম্ভব।

সি আর আবরার: শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী এবং দ্য রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) নির্বাহী পরিচালক

অনুবাদ করেছেন সুমাইয়া তারান্নুম সুবাহ

Comments

The Daily Star  | English

Ban on plastic bags a boon for eco-friendly sacks

Availability of raw materials now a challenge

7h ago