নয়া ট্রাম্পজমানা: কতটা সুযোগ কতটা বিপদ

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

আমরা যখন বাংলাদেশে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে উদ্বিগ্ন, যখন ভাবছি নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে এবং এই নিয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও ছাত্র উপদেষ্টারা কথার লড়াই চালাচ্ছেন—তখন বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে ঘটে চলেছে এক বড় পট পরিবর্তন। আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, 'দ্য ফিউচার ইজ আওয়ার্স, অ্যান্ড আওয়ার গোল্ডেন এইজ হ্যাজ জাস্ট বিগান'।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আমেরিকানদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে, তাদের সোনালি ভবিষ্যৎ আনতে ডোনাল্ড ট্রাম্প অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস আর শক্তিমত্তার সঙ্গে যা যা ঘোষণা দিয়েছেন, যা যা করবেন বলেছেন, তাতে পৃথিবীতে নতুন করে সংকট আরও ঘনীভূত হবে, নাকি সুযোগ তৈরি হবে। সুযোগ তৈরি হলে কাদের জন্য তা স্বস্তি আনবে, সংকটেই বা পড়বে কারা? বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যেই বা এই পরিবর্তন কতটা সুফল আনবে? নাকি নতুন ট্রাম্প-জমানায় নতুন বিপদের দেখা পাবে এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী, নতুন অবয়বে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখে নেই আদতেই দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে কী করছেন।

১. ডোনাল্ড জে ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭তম এবং নিজের দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নিয়েই যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, তার আগামী দিন হবে আমেরিকাকে গ্রেট করে গড়ে তোলা। 'মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন'। এই নীতিই হবে তার আগামী চার বছরের কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি।

২. এ কাজের অংশ হিসেবে তিনি অভিবাসন নীতির পরিবর্তনে নেমে পড়েছেনে। যার খড়গ পড়বে মেক্সিকো, ভারতসহ বহু দেশের অভিবাসীদের ওপর। এমনকি বাংলাদেশও তার হাত থেকে নিস্তার পাবে না।

আমেরিকার জনগণের ১৪ শতাংশেরও ওপরে রয়েছে অভিবাসীর সংখ্যা। প্রতিবছর এই অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের বয়ান বলছে, ২০২৩ সালে আমেরিকায় অভিবাসন বেড়েছে ১৬ লাখ। আমেরিকায় মেক্সিকানদের পরেই ভারতীয়রা দ্বিতীয় বৃহত্তম অভিবাসী গোষ্ঠী। অভিবাসীদের সংখ্যা যত বাড়ছে, স্থানীয় আমেরিকানরা সেটাকে তাদের চাকরি বা কর্মসংস্থানের ওপর এক ধরনের বাড়তি চাপ হিসেবে দেখছেন। ভোটের মাঠেও ট্রাম্প আমেরিকানদের এই মনোভাবকে ক্যাশ করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। ফলে এখন সেটাকে কাজে পরিণত করতে তিনি যারপর নাই মরিয়া।

৩. অন্যদিকে বাণিজ্যে অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়ে আমেরিকা অন্যদেশের পণ্য আমদানিকে কঠিন করে তুলে নিজের বাজারকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়। অন্য দেশের সঙ্গে তার বাণিজ্য বিনিময়কে অধিকতর আমেরিকামুখী করে তুলতে চান ট্রাম্প।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ঘোষণা দিয়েছেন, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা পণ্যে ১০শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর কথা ভাবছেন তিনি। তার এই ট্যারিফ যুদ্ধের নিশানা হবে ভারতও। কেননা, ভারত নিজের দেশে পণ্য ঢুকতে যে চড়া হারে শুল্ক বসায় অথচ তারা আমেরিকায় রপ্তানি করতে প্রত্যাশা করে উল্টোটা। ফলে আমেরিকার নয়া ট্রাম্প জমানার বড় বাণিজ্যিক হাতিয়ার হবে নয়া 'ট্যারিফ' আরোপ। যার নিশানা চীন, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়াসহ পৃথিবীর শক্তিমান অর্থনীতির বহুদেশ। বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের যে তরিকা এখন চলমান, ট্রাম্প তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবেন আমেরিকার ফেভারে 'ট্যারিফ গেম' খেলে।

৪. বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যেই এক নয়া কার্ড খেলেছেন। যেটা পৃথিবীর জ্বালানি রাজনীতির অভিমুখকে পরিবর্তন করে দেবে। এই জ্বালানি রাজনীতি বহু দেশের মূল রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে। শপথ নিয়েই তিনি বলেছেন, মাটির নিচে থাকা আমেরিকান খনিজ সম্পদকে তিনি তুলবেন, ব্যবহার করবেন এবং তা আমেরিকার জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে ব্যয় করবেন। নিজের দেশের খনিজ সম্পদ মাটির নিচে না রেখে তা তুলে দেশের অর্থনীতিতে সাম্যবস্থা আনবেন, রপ্তানি করবেন এবং জ্বালানি দাম নিজেদের অনুকূলে রাখার ব্যবস্থা নেবেন। নিজের দেশের জ্বালানি ব্যবহার করে তিনি আমেরিকাকে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানুফ্যাকচারিং দেশ হিসেবে গড়ে তুলবেন এই ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, 'উই উইল ড্রিল, বেবি, ড্রিল'।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের আলোচনায় অংশ নিয়ে এক ভার্চুয়াল বক্তব্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিষ্কার করেছেন তার আমেরিকান নয়ানীতি। তিনি বলেছেন, 'সৌদি আরব ও অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজকে (ওপেক) বলব, অপরিশোধিত তেলের দাম কমাতে। ওরা তেলের দাম কমালেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে যাবে।' বোঝাই যায় জ্বালানি দিয়েই বিশ্বরাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলতে চান তিনি।

৫. পৃথিবীর বৃহত্তম এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে আমেরিকা। ২০২৪ সালে আমেরিকা তার নিজস্ব মোট গ্যাস উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ রপ্তানি করেছে পৃথিবীর ৩২টি দেশে। আমেরিকার এলএনজি ব্যবহার করে ইউরোপ, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো।

২০২৪ সালে ফ্রান্স (১১ দশমিক ৫ শতাংশ), জাপান (৮ শতাংশ), নেদারল্যান্ড (৭ দশমিক ৬ শতাংশ), ভারত (৭ দশমিক ৩ শতাংশ), তুরস্ক (৬ দশমিক ৪ শতাংশ)—এই পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশি এলএনজি রপ্তানি করেছে আমেরিকা। ফলে, জ্বালানি বাণিজ্যে নতুন করে মোড়লিপনার সুযোগ যে নেবে আমেরিকা, সেটা এখন পরিষ্কার। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ইরান-চীন-রাশিয়া-ভারত যে জ্বালানি নেক্সাস গড়ে তুলেছিল, তার ওপর বড়ভাবে আঘাত হানবে আমেরিকান ট্রাম্প জমানা। যেটা এসব দেশের অর্থনীতিকে জটিল করে তুলতে পারে। বিশেষ করে, ভারত এই যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির বাড়তি সুযোগ হিসেবে আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাশিয়ার কম দামের জ্বালানি ব্যবহার করে পার পেয়ে এসেছে এতদিন। সেটা এখন বন্ধ করা ছাড়া ভারতের উপায় থাকবে না। এরকমভাবে ইরান-চীন-রাশিয়ার জ্বালানি নেক্সাসের সুবিধাপ্রাপ্ত বহুদেশের অর্থনীতি পড়বে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে।

৬. আমেরিকা তার অভিবাসন, ট্যারিফ, জ্বালানি নীতির বাইরে যেয়েও নতুন করে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার অন্যতম হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে তাদের প্রত্যাহার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আমেরিকান অর্থায়ন উঠে গেলে গোটা পৃথিবীতে তার প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রচলিত ব্যবস্থা সেখানেও আমেরিকা উল্টোপথে চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। গ্রিন এনার্জি বা রিনিউয়েবল এনার্জি ব্যবহারের যে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছিল, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট সেখানে চলতি হাওয়ার বিরুদ্ধে। ফলে জ্বালানি রূপান্তরের পথ ক্রমশ জটিল হয়ে উঠবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসায়িক লবি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশের সব পথকে সংকুচিত করে দেবে। এর যে অর্থনৈতিক চাপ, তা বহুদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।

সামাজিক খাতে অর্থায়নে বাইডেন প্রশাসনের যে নীতি ছিল তা পরিবর্তনের ফলে ট্রাম্পজমানায় বিশ্বব্যাপী সামাজিক-অর্থায়ন সংকুচিত হবে। ফলে এনজিও ফান্ডিং দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়ে পড়বে।

৭. আমেরিকার এই নতুন জমানার মূলমন্ত্র হচ্ছে, একদিকে সামরিক বাণিজ্যিক খাত বা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিজ, অন্যদিকে প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রিজের বিকাশ। মিলিটারি ও টেকনোলোজি খাতের শিল্পায়নের বাজারকে বিকাশ ও বিস্তৃতির মাধ্যমে আমেরিকার বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক-সামরিক স্বার্থ সুনিশ্চিত করতে যা যা করা দরকার তারা তা করবে।

চীনকে ক্রমশ বাণিজ্যিকভাবে দুর্বল করার উদ্যোগ নেবে এই নয়াট্রাম্প জমানা। ফলে দুনিয়াতে নতুন করে রাশিয়া-চীন-ইরান-ভারতের একটা বড় অর্থনৈতিক বলয় গড়ে তোলার চেষ্টাও চলবে। সেটাও পৃথিবীতে বহুদেশের বর্তমান রাজনৈতিক চলমান ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে।

পুনশ্চ: এই লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন তার ফেসবুক পেজে জানাচ্ছেন, 'বাংলাদেশ সরকার আজকে (২৫ জানুয়ারি ২০২৫) ট্রাম্পের নতুন এনার্জি এক্সপোর্ট ম্যান্ডেটের ওপর ভিত্তি করে একটা ল্যান্ডমার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট সাইন করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমরাই প্রথম দেশ কোনো ডিল সাইন করলাম।' এই খবর বলছে বাংলাদেশের সরকার মার্কিন কোম্পানি আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে বছরে ৫০ লাখ টন এলএনজি বা তরল গ্যাস আমদানির এই চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো—কী দামে এই এলএনজি কেনা হলো? এটা কি প্রতিযোগিতামূলক দরে কেনা হলো? নাকি দ্বিপাক্ষিক নেগোসিয়েশন?

এসব বিষয়ে কোনো তথ্য আপাতত নেই। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার, ড. ইউনূসের বর্তমান সরকার আমেরিকার নয়াজমানার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে চলতে আগ্রহী।

বাংলাদেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে দারুণ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতির সুরক্ষা কীভাবে হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্নও বটে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে কলহপ্রবণতা, তা ইতোমধ্যেই সুস্পষ্ট। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান রাজনীতিতে অনেক নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করেছে। প্রায় চার কোটি নতুন ভোটার এবং বিপুল তরুণরা জনসংখ্যার অধিক্যে সংযুক্ত। বয়স্ক ও নতুন জেনারেশনের চিন্তা ও কাজের প্রক্রিয়ায় বিস্তর ফারাকও দৃশ্যমান। সমাজের নানাস্তরে বিভিন্ন রকম পরিবর্তনের আলামত সুস্পষ্ট।

প্রচলিত রাজনীতি অতীতে সুশাসন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক ব্যর্থতাই অরাজনৈতিক সরকার ও শাসনকে জায়গা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে নির্বাচন কখন হবে, সংস্কার কীভাবে হবে, ফ্যাসিবাদের বিচার ও রাজনৈতিক পুনর্বাসন কীভাবে হবে—এসব প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যের বদলে বিভাজন বিকশিত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ট্রাম্পের নয়াজমানার সুফল ঘরে আনতে দারুণ মুনশিয়ানা দেখাতে হবে।

ড. ইউনূস তার ইউরোপ-আমেরিকান বন্ধুদের ব্যবহার করে এই ট্রাম্পজমানার নয়া ব্যবস্থাপনার সুযোগ যদি কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের জন্য সুফল তরান্বিত হতে পারে। তবে তার জন্য প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন। আবার সেটা সক্রিয় হলে নির্বাচন তরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। সেটাও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য উদ্বেগের। দেখার বিষয়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ট্রাম্পজমানার নতুন দিনে কতটা নতুন কৌশল বের করে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেন।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English

Please don't resign: An appeal to Prof Yunus

Every beat of my patriotic heart, every spark of my nation building energy, every iota of my common sense, every conclusion of my rational thinking compels me to most ardently, passionately and humbly appeal to Prof Yunus not to resign from the position of holding the helm of the nation at this crucial time.

5h ago