গাজা গণহত্যা: ইসরায়েলের মিথ্যাচার ও বাস্তবতা

দক্ষিণ আফ্রিকার মানবাধিকারকর্মী নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, তা আমাদের অতীতের বর্ণবাদী শাসনের চেয়েও ভয়াবহ।
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার অন্যতম ভয়াবহ পরিকল্পনার অংশ হলো চলমান 'গণহত্যা' যা দখলদার ইসরায়েল নির্মম প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে অব্যাহত রেখেছে।
১৯৫১ সালের গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা হলো, কোনো জাতীয়, নৃতাত্ত্বিক, গোষ্ঠীগত বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত কর্ম, যা নিম্নলিখিত যেকোনো কর্মকাণ্ড বোঝায়। যেমন—সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা করা, গোষ্ঠীর সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি সাধন করা, গোষ্ঠীর ওপর এমন জীবনযাপনের শর্ত আরোপ করা যা তাদের সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে শারীরিক ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত, গোষ্ঠীর মধ্যে জন্মহার প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া, গোষ্ঠীর শিশুদের জোরপূর্বক অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর করা।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিস বয়েলের মতে, 'ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের নীতিগুলো গণহত্যা কনভেনশনের সব শর্ত পূরণ করে।'
এমন স্থানে এই গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে নেই খাবার, ওষুধ, আশ্রয়, বিশুদ্ধ পানি কিংবা বিদ্যুৎ। তার ওপর সেখানে চলছে অবিরাম বোমা হামলা, প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। সম্ভবত এটিই হবে পৃথিবীর ইতিহাসে 'গণহত্যা'র শেষ অধ্যায়—যেখানে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ নিহত হচ্ছে, যা শিগগির লক্ষাধিক প্রাণহানিতে পরিণত হতে পারে। অথবা, তাদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হবে, যাতে তারা কখনোই ফিরতে না পারে।
ইসরায়েলের উন্মত্ত গণহত্যা, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন, আর সেটাই কি বাস্তব হতে চলেছে? এখানে এসে পশ্চিমা জাতি, আইনের শাসন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং তথাকথিত সভ্যতার রক্ষকদের মুখোশ চিরতরে খুলে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের মিথ্যাচারও এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। যেমন—ইসরায়েল দুই-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান চায়, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন মেনে চলে, হামাস হাসপাতাল ও স্কুলগুলোকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে বলে শুধু সেগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হয়, হামাস বেসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ আছে কারণ হামাস ট্রাকগুলো দখল করছে বা অস্ত্র পাচার করছে, গাজায় নিহতদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ হামাস 'সন্ত্রাসী' এবং হামাস অস্ত্র সংগ্রহ করছে ও নতুন যোদ্ধা নিয়োগ করছে বলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গেছে—এসব শুধুই মিথ্যা বুলি, আর কিছুই নয়।
এসব মিথ্যার আড়ালে ইসরায়েলের গণহত্যার প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হয়েছে, যা এর মধ্যেও প্রমাণিত হয় যে, তারা উত্তর গাজার বাসিন্দাদের জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া মাধ্যমে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা ধ্বংসস্তূপে আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট গত ২১ মার্চ জানিয়েছে, তাদের মাত্র ছয় দিনের ময়দার মজুত অবশিষ্ট আছে। দূষিত পানি ও খাদ্য সংকটের কারণে রোগে মৃত্যু, বোমা, মিসাইল, গোলাগুলি ও অবিরাম হামলায় প্রতিদিন বহু হতাহত হচ্ছে।
এটাই গাজার বাস্তবতা যে, একটি যুদ্ধ যা কখনো শেষ হয় না, কখনো বিরতি দেয় না, কেউ দয়া দেখায় না। গত ১৮ মার্চ ইসরায়েল আবারও গাজায় বোমাবর্ষণ শুরু করে, আর এর মধ্যে এটি প্রমাণ হয় যে, ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া 'তথাকথিত' যুদ্ধবিরতি কখনোই প্রকৃত অর্থে অস্তিত্বশীল ছিল না। বোমা হামলা কখনো সত্যিকার অর্থে থামেনি। গাজার সীমান্ত বন্ধই রয়ে গেছে। মানবিক সহায়তা আটকে রাখা হয়েছে। ক্ষুধা আরও গভীর হয়েছে। হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। পরিবারগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাড়ির মধ্যে বা আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত খাবার বা পানিও নেই। এমনকি পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল তার দমননীতি আরও কঠোর করেছে। আর এটাও নিশ্চিত করেছে যে ২১ লাখ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে বঞ্চিত করা হবে।
সাধারণ মানুষদের আবারও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। সাংবাদিক, শিশু এবং সাহায্যকর্মীরা—যারা সত্য ঘটনাগুলো নথিভুক্ত করার চেষ্টা করছে এবং আহতদের সাহায্য করছে, তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
সর্বশেষ হামলার শুরু থেকে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কেউ নিহত হয়েছেন মাঠ থেকে প্রতিবেদন করার সময়, কেউবা তাদের নিজ বাড়িতে হামলার শিকার হয়েছেন। তরুণ সাংবাদিক খালেদ আবু সাইফ নির্ভীকভাবে গাজার দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরতেন। ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনি যখন নিহত হন তখন তার আবাসস্থল বিধ্বস্ত হয়। তার ক্যামেরাটি তার মৃতদেহের পাশে পাওয়া যায়।
সম্ভবত ইসরায়েল তার হামলা বন্ধ করবে না, এমনকি বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হলেও গাজায় অবরোধ ও বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা যেকোনো ধরনের অজুহাত দাঁড় করাতে প্রস্তুত। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এই হত্যাযজ্ঞে উল্লাস প্রকাশ করছে, আর যারা গণহত্যার সমালোচনা করছে, তাদের 'ইহুদিবিদ্বেষী' বলে আক্রমণ করা হচ্ছে—যা দীর্ঘদিনের ইসরায়েলের একটি অপকৌশল। এটাই ফ্যাসিবাদের প্রকৃত রূপ, যা আধুনিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে পরিচালিত হয়ে আসছে।
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক আগ্রাসন তার উপনিবেশবাদী প্রকল্প ও বর্ণবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিণতি অনিবার্য। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সমগ্র ফিলিস্তিন দখল, যেখানে পশ্চিম তীরও শিগগির ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। আর ফিলিস্তিনিদের চিরতরে বাস্তুচ্যুত করা হবে।
এই লেখার সমাপ্তির টানতে চাই রাশিয়ার প্রখ্যাত দার্শনিক আলেকজান্ডার দুগিনের একটা বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, 'ট্রাম্প ও ইসরায়েল গাজার জনগণকে স্থানচ্যুত করবে এবং আরব ও ইসলামি দেশগুলোর বিরুদ্ধে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, যদি না মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আত্মত্যাগ করে, যেমন রাশিয়া করেছে। আজকের সিদ্ধান্ত তাদের হাতে, যাদের ক্ষমতা রয়েছে।'
তথ্যসূত্র
1. Tutu, D. (2014). No future without forgiveness. Doubleday.
2. United Nations. (1948). Convention on the prevention and punishment of the crime of genocide.
https://www.un.org/en/genocideprevention/documents/Genocide_Convention.pdf.
3. Boyle, F. (2013). Palestine, Palestinians, and international law. Clarity Press.
4. United Nations Relief and Works Agency for Palestine Refugees in the Near East (UNRWA). (2025, March 21). Official statement on humanitarian crisis in Gaza. https://www.unrwa.org
5. Dugin, A. (2023). The last war of the world-island: The geopolitics of contemporary Russia. Arktos Media.
6. scheerpost.com
7. thecradle.com
8. News.antiwar.com
মিজান রেমান: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Comments