বাণিজ্যযুদ্ধে ট্রাম্প মডেল: কার সুখ কার অসুখ...

ট্রাম্পের হাতে নতুন শুল্ক চার্ট। ছবি: এএফপি
ট্রাম্পের হাতে নতুন শুল্ক চার্ট। ছবি: এএফপি

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছেন নয়া ও বাড়তি শুল্ক আরোপের মাধ্যমে, তা গোটা পৃথিবীকে অস্থির, উদ্বিগ্ন ও প্রায় অসুস্থ করে তুলেছে, এটা এখন আর অজানা নয়। ট্রাম্প সর্বশেষ ৯০ দিনের জন্য তার নয়াআরোপিত শুল্ক স্থগিত করেছেন—ব্যতিক্রম শুধু চীন।

চীনের সঙ্গে তার পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ ভয়াবহ সীমা অতিক্রম করেছে। চীনও থেমে নেই। সেও আমেরিকান পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে, মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছে চীন। এর আগে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। চীন-আমেরিকার এই বাণিজ্যযুদ্ধ কোথায় নেবে আমাদের, সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে দেখি, ট্রাম্প কেনো এসব করছেন?

ট্রাম্পের শুল্কদর্শন

নির্বাচনের আগে থেকেই ট্রাম্প বলছিলেন, কয়েক দশক ধরে আমেরিকাকে কাছের ও দূরের দেশগুলো, বন্ধু ও শত্রু উভয়ের দ্বারা লুটপাট ও লুণ্ঠন করা হয়েছে। কেননা তার মতে, এসব দেশ আমেরিকাতে যখন রপ্তানি করে তখন শুল্কছাড় সুবিধা নেয়। আবার আমেরিকার পণ্য যখন আমদানি করে তখন শুল্ক বাড়ায়।

ফলে, ট্রাম্পের সহজ হিসাব হচ্ছে, এর ফলে আমেরিকার সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি দিনকে দিন বাড়ছেই। এটা ট্রাম্পের মতে 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' কাজের প্রধানতম বাধা। তাই তার স্পষ্ট ভাবনা হচ্ছে:

১. আমেরিকার সপক্ষে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে বা বেটার ট্রেড ডিল করতে হবে।

২. আমেরিকার শিল্পকে চাঙ্গা করতে হবে বা আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রির বুষ্টিং ঘটাতে হবে।

৩. চীনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে বাণিজ্যে পরাস্ত করতে হবে।

৪. আমেরিকার শুল্ক রাজস্ব বাড়াতে হবে।

৫. আমেরিকান ভোক্তাদের জন্য কম দামে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

ট্রাম্পের চিন্তা পরিষ্কার। বেটার ট্রেড ডিলের মাধ্যমে আমেরিকার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের শুল্ক নতুন করে এমনভাবে ধার্য্য করতে হবে, যাতে সবক্ষেত্রেই আমেরিকার রাজস্ব বাড়ে। সবদেশের সঙ্গে তার নয়া আলোচনা দরকার। সেটা সহজে হবে না। তাই আচানক নির্বাহী আদেশে আমেরিকা নয়াশুল্ক ধার্য্য করে আবার ৯০ দিনের জন্য তা স্থগিত করেছে। এই সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে বা হচ্ছে।

এই আলোচনা যেহেতু আমেরিকানমুখী, ফলে এখানে দেশগুলো আমেরিকার কথাতেই রাজি হতে হবে। আমেরিকার বশ্যতাই স্বীকার করতে হবে। এখানে আমেরিকার স্বার্থই প্রাধান্য পাবে। আপাতত ট্রাম্পের ভাবনাটা সেরকমই।

আমেরিকায় যেসব দেশ রপ্তানি করে, শুল্কবাধায় তা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার সমাধান দুভাবে হতে পারে। প্রথমত, সেসব দেশকে আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হবে। তাতে আমেরিকার পণ্য কম শুল্কে নিতে হবে। সেটা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ শিল্পকে চাঙ্গা করবে। আমেরিকার বাজারে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকায় রপ্তানি করতে হলে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে শুল্ক বাড়াবে আমেরিকা। সেটাও তার অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়াবে, আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। আমেরিকান অর্থনীতির চেহারা পুষ্ট হবে তাতে, ঘটবে আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রিজের বুমিং।

চীনের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে একটা ঝাঁকি দেওয়ার ইচ্ছেটা ট্রাম্পের অনেক পুরনো। তিনি জানেন, বাণিজ্যযুদ্ধে তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির নিরিখে দেশ হিসেবে চীনই সর্বাগ্রে। কাজেই চীনকে এই শুল্কযুদ্ধে নামিয়ে আনতে না পারলে তার 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' প্রকল্প হালে পানি পাবে না।

যদিও এই লড়াইয়ে ঝুঁকি অনেক, তবুও সেটাতেই আগ্রহ ট্রাম্পের। চীন এখনো ট্রাম্পের কাছে নতিস্বীকার করেনি। চীনও সমান তালে আমেরিকার পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্পের সঙ্গে এই বাণিজ্য লড়াই অব্যাহতই রেখেছে।

এসব উদ্যোগে ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য একটাই, সেটা হলো রাজস্ব আয় বাড়ানো। ট্রাম্প পরিষ্কার বলেছেন, এখন আমাদের উন্নতির পালা। সেটা করতে, আমাদের কর কমাতে ও জাতীয় ঋণ পরিশোধ করতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যবহার করতে হবে এবং এটি খুব দ্রুত ঘটবে। গত বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণার সময় ট্রাম্প নিয়মিতভাবে বলেছেন, তার প্রস্তাবিত শুল্কের ফলে বিপুল পরিমাণ নতুন রাজস্ব আসবে, যা আমেরিকা তার বাজেট ঘাটতি কমাতে, কর কর্তনের তহবিল এবং নতুন সরকারি কর্মসূচির জন্য অর্থ প্রদান করতে ব্যবহার করতে পারে।

শুল্ক আরোপ, বাণিজ্যযুদ্ধ এসব চালিয়ে ট্রাম্প শেষাবধি আমেরিকান বাজারে মার্কিন ভোক্তাদের কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে চান। মার্কিন ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে চান। ট্রাম্পের ভাবনা, দেশে আরও উৎপাদনের অর্থ হবে প্রতিযোগিতা আরও শক্তিশালী করা এবং ভোক্তাদের জন্য কম দাম নিশ্চিত করা।

ট্রাম্প নিরলসভাবে বলে এসেছেন তার ইচ্ছা হচ্ছে, আমেরিকান গ্রাহকদের জন্য খরচ কমানোর ব্যবস্থা এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার বাণিজ্যনীতি এটি মোকাবিলায় সহায়তা করবে। এটিই আমেরিকাকে স্বর্ণযুগে প্রবেশ করাবে এবং আমেরিকানরা আবারও 'গ্রেট' বলে নিজেদের ভাবতে সক্ষম হবেন।

চীন, বাণিজ্য ঘাটতি ও বাস্তবতা

ট্রাম্প কয়েক দশক ধরে বলে আসছেন, শুল্ক হলো আমেরিকার উৎপাদন ভিত্তি পুনর্গঠনের একটি কার্যকর উপায়, যা অন্যায্য বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করে, বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ায়।

চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য দশার হালচালকে গভীরভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন ট্রাম্প। ২০২৪ সালে চীনে মার্কিন রপ্তানি ১৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৩ শতাংশ কম। এদিকে, আমদানি প্রায় একই পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর ফলে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, যা গত বছর ২৯৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর সূত্র বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। চীনকে নিয়ে ট্রাম্পের মাথাব্যথার একটা বড় কারণ এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি।

আমেরিকা চীন থেকে আমদানি করে বিপুল পণ্য। ভোগ্যপণ্য ও প্রযুক্তির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চীনা উৎপাদনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে আমেরিকা। চীন থেকে আমদানি করা প্রধান পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিফোন, কম্পিউটার, সেমিকন্ডাক্টর, আসবাবপত্র, খেলনা ও টেক্সটাইল। বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্য অনুসারে, মোট আমদানি মূল্যের ৫০ শতাংশের বেশি ইলেকট্রনিক্স ও যন্ত্রপাতি।

বিপরীতে, চীনে মার্কিন রপ্তানি আরও বৈচিত্র্যময়, কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে যথেষ্ট কম। মূলত উড়োজাহাজ, যানবাহন, সেমিকন্ডাক্টর, শিল্প যন্ত্রপাতি, সয়াবিন ও গরুর মাংসের মতো কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আমেরিকা।

মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর সূত্র মতে, চীন ছাড়াও আরও অনেকগুলো দেশের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ট্রাম্পের দুশ্চিন্তার কারণ। ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চীন ছাড়াও যেসব দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সুইজারল্যান্ড (৩৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার), মেক্সিকো (২৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার), আয়ারল্যান্ড (২৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার), ভিয়েতনাম (২২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার), কানাডা (১৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার), তাইওয়ান (১৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার), জার্মানি (১৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার), জাপান (১১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার), ভারত (৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার)।

আশংকা ও বিপত্তি

ট্রাম্পের এই বাণিজ্যযুদ্ধ শুধু আমেরিকাকেই জয়যুক্ত করার মিশন। তার 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ। কিন্তু ট্রাম্প মনে রাখতে চান না যে, আমেরিকা গোলকায়নের অন্যতম শক্তিধর দেশ। তার এই শক্তিমত্তার বড় ভিত্তি বিশ্বায়ন ও মুক্তবাণিজ্য। আমেরিকার মিত্রশক্তিও তার ক্ষমতার এক বড় আধার। এই ইকোসিস্টেম টিকে আছে যুক্তি, পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ এবং ন্যায্যতার ওপর। যার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে বেশকিছু বৈশ্বিক সংস্থা ও আইনকানুন।

ট্রাম্প সেসবের তোয়াক্কা করছেন না। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাহী আদেশ দেওয়ার সময় তিনি ভুলে যাচ্ছেন, ডব্লিউটিও বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপস্থিতি। ফলে, ট্রাম্পের এই একতরফা ও অর্বাচীন চিন্তা এবং কাজ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে এক ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। তার এসব উদ্যোগ ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপি শেয়ারবাজার, স্বর্ণের দাম, ডলারের দাম, জ্বালানি তেলের দামের বাজারে তৈরি করেছে অস্থিরতা। এই অস্থিরতা বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে সুযোগ ও বিপদের এক অজানা, অনির্ণেয় পরিবেশের মধ্যে ফেলেছে। সেটা গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বিপদাপন্ন করতে পারে। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে তার বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী মন্দার সূত্রপাত করতে পারে বলেও অনেকে আশংকা প্রকাশ করছেন।

পুনশ্চ: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' শ্লোগান দিয়ে নির্বাচনে জিতেছেন। এখন তিনি সেটা বাস্তবায়ন করতে চান। কিন্তু মনে রাখতে হবে 'গ্রেট' কথাটার মধ্যে যে ন্যায্যতা-সুস্থিরতা-সুশাসন উপস্থিত থাকে, ট্রাম্পের রাষ্ট্রনৈতিক আচরণের মধ্যে তা নেই। তার মধ্যে আছে অন্যকে অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করার একরোখা বেপরোয়া মনোভাব। একধরণের লোকরঞ্জনবাদি সংকীর্ণ রাজনীতির প্রবণতা। যেটা বৈশ্বিক আন্তসম্পর্ক তৈরিতে ভীষণ বৈপরীত্য তৈরি করে।

আমেরিকার যে বৈশ্বিক অবস্থান, সেটা দাঁড়িয়েই আছে মিত্রদের সঙ্গে মিলনের শক্তির ওপর। ট্রাম্প সেখানেই কুঠারাঘাত করতে চাইছেন। ফলে, আপাতত এই শুল্কযুদ্ধ অস্থিরতা তৈরি করলেও, নিজেদের বাঁচাতে চীনসহ পৃথিবীর অপরাপর দেশগুলোর মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মেরুকরণ ঘটতে পারে, গড়ে উঠতে পারে নতুন বলয়। সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে আমেরিকার অর্থনীতিতেই দুঃখদশা নিয়ে।

আবার ট্রাম্পের এই বেয়াড়া ও বেপরোয়া আচরণের ফলাফলে আমেরিকান নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারেন। আপাতত বলা যায়, ট্রাম্প বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের জন্য একটা অস্থিরতার আধার হয়ে উঠেছেন। বিপদ ও বিপত্তির কারণ হয়ে থাকছেন।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English
National Consensus Commission Holds Talks with BNP, Jamaat, and NCP

Parties split over ‘pluralism’, nat’l constitutional council

The National Consensus Commission’s talks with major political parties have yielded a broad consensus on key issues such as caretaker government system and a bicameral parliament, but the parties remain divided on some sensitive questions.

11h ago