আগামী নির্বাচনে বিএনপি কতগুলো আসন পাবে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে জনপরিসরের আলোচনা হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হবে এবং সরকার গঠন করবে। অনেকে এমনও বলার চেষ্টা করেছেন, বিএনপি আড়াইশো আসনে জিতবে। বিশেষ করে বিএনপির অনেক নেতার ধারণা এরকমই।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত ২৭ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা যুবদলের ইফতার মাহফিলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশিদ বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নির্বাচন হলে বিএনপি একাই ৯০ ভাগের বেশি আসন পাবে।'
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির 'বিপুল জনপ্রিয়তার' এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তার দাবি, বিএনপির এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আগামী নির্বাচনে ৫০ থেকে ১০০টির বেশি আসন পাবে না। তার ভাষায়, 'বিএনপির লিডারশিপ পুরোটাই ফেইলিওর। আমরা মনে করি না বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হবে।'
হারুনুর রশিদ আর নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী দুজনই 'পরিস্থিতি' শব্দটিতে জোর দিয়েছেন। একজন মনে করছেন পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূলে, অন্যজন মনে করছেন পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে নেই।
এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন এই 'পরিস্থিতির' জন্য দলটির নেতৃত্বকে দায়ী করছেন। অর্থাৎ, বিএনপির জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করছেন না, বরং দলের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা বলছেন।
বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, সেটা গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে সারা দেশে তাদের বিরুদ্ধে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন ও সংঘর্ষের যেসব খবর প্রতিনিয়তই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষকে বলতে শোনা যায়—সরকার গঠনের আগেই এই অবস্থা, সরকার গঠন হয়ে গেলে কী করবে!
দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমান বারবারই এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের সতর্ক করছেন। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব বন্ধ হচ্ছে না।
বাস্তবতা হলো, বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় আর্থিক, শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এমনকি পারিবারিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাহলে কি এখন একসঙ্গে সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাচ্ছেন? তারচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা দলের জন্য কাজ করার বিনিময়ে কী পাবেন, মূলধারার কোনো দলেরই সেই পরিকল্পনা নেই— দুয়েকটি ছাড়া। অর্থাৎ দলের নেতাকর্মীরা দলের জন্য কাজ করেন মূলত পদ-পদবি, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। অধিকাংশ দলেরই কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেই যে, তাদের নেতাকর্মীরা দলের জন্য কাজ করার বিনিময়ে সম্মানজনক উপায়ে কী কী পাবেন। ফলে যখনই সুযোগ আসে, তারা যেকোনো উপায়ে টাকা কামাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি ৯০ শতাংশের বেশি আসন পাবে—এই কথা হারুনুর রশিদ কিসের ভিত্তিতে বললেন? তারা জরিপ করেছেন? একইভাবে বিএনপি ৫০ থেকে ১০০টির বেশি আসন পাবে না—এই কথা নাসীরুদ্দীনের ব্যক্তিগত ধারণা, নাকি তার দলও এমনটা মনে করে? তারাই বা এই অংক কীভাবে জানলেন? মাঠপর্যায়ে কোনো জরিপ চালিয়েছেন? নাকি এটি নিতান্তই কথার কথা?
বাংলাদেশে অতীতের নির্বাচনগুলো, বিশেষ করে তুলনামূলক ভালো ও কম বিতর্কিত চারটি নির্বাচনের (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেশের বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। যদিও ২০০৮ সালের পরে গত ১৭ বছরে নদীর জল অনেক ঘোলা হয়েছে, রাজনীতি ও ক্ষমতাকাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। ফলে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা যাচাই করা যাবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। তারপরও একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়ার জন্য পরিসংখ্যানে চোখ বুলানো যাক।
- ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় ১৪০টি আসনে, ভোট পায় ৩০.৮ শতাংশ; আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ৮৮টি আসনে, ভোট পায় ৩০.১ শতাংশ।
- ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ১৪৬টি আসনে, ভোট পায় ৩৭.৪৪ শতাংশ; বিএনপি জয়ী হয় ১১৬টি আসনে, ভোট পায় ৩৩.৬০ শতাংশ।
- ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় ১৯৩টি আসনে, ভোট পায় ৪১.৪ শতাংশ; আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ৬২টি আসনে, ভোট পায় ৪০.২ শতাংশ।
- ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২৩০টি আসনে, ভোট পায় ৪৮.৪ শতাংশ। বিএনপি জয়ী হয় মাত্র ৩০টি আসনে, কিন্তু ভোট পায় ৩২.৫০ শতাংশ। অর্থাৎ আসন সংখ্যায় দুই দলের বিশাল পার্থক্য হলেও ভোটের শতকরা হারের পার্থক্য সেই তুলনায় অনেক কম।
এই চারটি নির্বাচনে দল দুটির প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার গড় হিসাব করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৩৮.৯ শতাংশ ভোট, আর বিএনপি ৩৪.৫৭ শতাংশ। সেই হিসাবে সরল অংকে এটা বলা যায়, দেশের ৩৮.৯ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল, আর বিএনপির পক্ষে ছিল ৩৪.৫৭ শতাংশ মানুষ।
প্রশ্ন হলো, বাস্তবতা সেই জায়গায় এখনও আছে কি? গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, দলের শীর্ষ অনেক নেতার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া; দেশের ভেতরে অনেকের আত্মগোপন এবং অনেকের গ্রেপ্তারের মতো ঘটনায় দলটি যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার ভোট বা জনপ্রিয়তা কি আর ৩৮ শতাংশে আছে?
বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেভাবে পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, তাতে তাদের জনপ্রিয়তা বা জনসম্পৃক্ততা কি ২০০৮ সালের জায়গাতেই আছে নাকি অনেক কমেছে? যদি কমে তাহলে এখন তাদের ভোট কত? তার বিপরীতে বিএনপির যে জনপ্রিয়তার হিসাব দেওয়া হলো ২০০৮ সাল পর্যন্ত—এখনও কি তারা সেখানে আছে, নাকি তাদের জনপ্রিয়তা ও ভোট কমেছে বা বেড়েছে?
২০১৪ থেকে পরবর্তী তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচনই বিএনপি বর্জন করেছে। একটিতে অংশ নিলেও বিতর্কিত নির্বাচন হওয়ায় ওই নির্বাচনের ফলাফল দিয়েও বিএনপির জনপ্রিয়তা মাপার সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপির ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে দমন-পীড়ন চালিয়েছে, তাতে অনেকের মনে এই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল যে, বিএনপি হয়তো আর কোনোদিনই মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু হয়েছে উল্টো। অব্যাহত দমন-পীড়নের মুখে থেকেও বিএনপি আরও শক্তিশালী হয়েছে।
কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ৩৫ শতাংশে আছে নাকি বেড়েছে বা কমেছে—সেটি পরীক্ষা করা যায়নি। এই পরীক্ষার একমাত্র উপায় অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
বিএনপির যদি প্রায় ৩৫ শতাংশ ভোট থাকে, তাহলে তাদের ১০৫টি আসনে জয়ী হওয়ার কথা। সেই হিসাবে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর খুব ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু অতীতের পরিসংখ্যান বলছে, ভোটের শতকরা হার কম হলেও আসন সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। যার উদাহরণ ২০০৮ সালের নির্বাচন।
ধরা যাক, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের ভোট অনেক কমেছে। কিন্তু সেটা কত? ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটও কি তাদের নেই? যদি থেকে থাকে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে না পারলে এই ভোটাররা আগামী নির্বাচনে কোন দলকে ভোট দেবে? তারা কি ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে?
আওয়ামী লীগের প্রধান দোসর—এমন অভিযোগে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচন করতে না দেওয়ার একটা দাবি আছে এনসিপির তরফে। তারা এখনও এই দাবিটি সরাসরি উত্থাপন করেনি। কিন্তু জাতীয় পার্টির ব্যাপারে তাদের যে অবস্থান, তাতে হয়তো শিগগির এই দাবি তুলবে। সুতরাং সরকার যদি আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করে এবং তারা যদি শেষমেষ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না পায়, তাহলে তাদের ভোটাররাই বা কাকে ভোট দেবে?
অনেকে মনে করেন, জাতীয় পার্টি ভোটের মাঠে থাকলে আওয়ামী লীগের ভোটগুলো তারাই পাবে; এমন আশঙ্কা থেকেই এনসিপি বা জামায়াতে ইসলামী হয়তো চাইবে জাতীয় পার্টি ভোটের মাঠে না থাকুক। এই ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান কী হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
হারুনুর রশিদের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী বিএনপি ৯০ শতাংশ আসন পাবে—এটা অবাস্তব কথা। কেননা, একটি দল ৯০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৭০টি আসন পাবে, আর অন্য সব দল মিলে মাত্র ৩০টি আসন পাবে, এটা অবিশ্বাস্য। যদি এমনই হয় যে, দেশের মানুষ কোনো একটি দলকে সত্যিই ৯০ শতাংশ আসনে বিজয়ী করেছে, তাহলে তার পক্ষে স্বৈরাচার না হয়ে উপায় থাকবে না। কেননা, যখনই কোনো একটি দল এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন বিরোধী দল বলে কিছু থাকে না। থাকলেও সেটি হয় নামমাত্র—জাতীয় পার্টির মতো 'সরকারি বিরোধী দল'।
দেশ একটি বিরাট গণঅভ্যুত্থানের পরে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে এবং যে ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে আগামী নির্বাচনে কোনো দলেরই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর হবে না। বরং আসন প্রাপ্তির দিক দিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন—যাতে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করা যায়, যারা সরকারকে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করবে।
তবে বিএনপি ১০০ আসন পাবে নাকি ১৫০, তারচেয়ে বড় প্রশ্ন নির্বাচন আসলে কবে হবে এবং সেটি কেমন নির্বাচন হবে?
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন। তার কথাই যেন সত্যি হয়। ভোটের নামে যে প্রহসন দেখে দেখে এই দেশের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং যে প্রজন্ম এখন পর্যন্ত ভোট দেওয়ারই সুযোগ পায়নি, তারা যেন একটি সত্যিকারের সুন্দর নির্বাচন দেখতে পারে এবং তার মধ্য দিয়ে দেশ প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুরু করতে পারে, সেখানে সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোরও।
নির্বাচন ছাড়া দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগ করার মানসিকতা আখেরে দেশকে পিছিয়ে দেয়। বরং, দেশের পুরোনো ও নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কতটুকু, সেটি পরীক্ষা করার একমাত্র সুযোগ যে নির্বাচন, সেই নির্বাচন যাতে কোনো অজুহাতেই পিছিয়ে না যায় বা অনিশ্চয়তার মুখে না পড়ে; সেই নির্বাচনটি যাতে কোনোভাবে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ না হয়—সেই প্রত্যাশা সরকারের কাছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে।
বিএনপি ১০০ আসন পাবে; এককভাবে নির্বাচন করলে এনসিপির অধিকাংশ প্রার্থী জামানত হারাবেন—এই ধরনের কথা রাজনীতিতে চালু থাকবে। কিন্তু আসলে কী হবে, সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার কেবল জনগণের এবং সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের একমাত্র উপায় একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনটি যত দ্রুত হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments