বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে জাপানিরা!
জাপান জিতবে বিশ্বকাপ শিরোপা- বিশ্বকাপ শুরুর আগে এই কথা বলার সাহস খোদ জাপানিরাও হয়তো করতো না। কিন্তু নিজেদের গ্রুপ পর্বে প্রথম ম্যাচে জার্মানি আর শেষ ম্যাচে স্পেনকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেষ ষোলো নিশ্চিত করার পর এখন জাপানি সমর্থকরা স্বপ্ন দেখছে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের!
নিজেদের প্রথম ম্যাচে জার্মানিকে হারানো পর সেই ম্যাচটিকে বিশ্বকাপের অঘটন বলা হয়েছিলো, কিন্তু স্পেনের বিপক্ষে যেভাবে পুরো ম্যাচে স্পেনের আধিপত্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আক্রমণাত্মক আর রক্ষণাত্মক ফুটবলের যে অনন্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে ম্যাচ জিতে নিয়েছে জাপান, আর যাই হোক এই ম্যাচটিকে অঘটন বলা যায় না। স্পেন ভালো খেললেও যোগ্য দল হিসেবেই তারা স্পেনকে হারিয়েছে। বিশ্বকাপের সব হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে বিশ্বকাপে সবসময়ের হট ফেভারিট দুই দল স্পেন আর জার্মানিকে পেছনে ফেলে জাপান হয়েছে নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন। অন্যদিকে ফুটবলে জাপানের এই উত্থানে কোস্টারিকাকে হারিয়েও বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি।
প্রথম ম্যাচে জার্মানিকে হারিয়ে জাপানি সমর্থকরা খুশিতে ফেটে পড়েছিলেন, কাল স্পেনকে হারানোর পর তাদের খুশির সঙ্গে যোগ হলো কান্না। খেলা শেষে স্টেডিয়ামের বড় স্ক্রিনে জাপানকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দেখাচ্ছিলো তখন আমার পাশে বসে খুশিতে কাঁদছিল জাপানের ওসাকার মেয়ে আয়িশি আর হাত মুঠো করে জাপানি ভাষায় চিৎকার করে কি যেন বলছিলো। শুধু আয়িশিই নয়, স্টেডিয়ামে থাকা জাপান সমর্থকদের অনেককেই তখন খুশিতে কাঁদতে দেখা গেছে। আয়িশির সঙ্গে আমি কথা শুরু করলাম, আয়িশি আমার কাছে প্রথমেই জানতে চাইলো শেষ ষোলো বা কোয়ার্টার ফাইনালে জাপান ম্যাচের কোনো অতিরিক্ত টিকেট আমার কাছে আছে কিনা। আমি বললাম নাই। তখন আমাকে জানালো, বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে এমন গ্রুপে পড়েছিলো জাপান তাই সে ভাবেই নাই এই গ্রুপ থেকে বিশ্ব ফুটবলের দুই পরাশক্তি স্পেন আর জার্মানিকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরবর্তী রাউন্ডে যাবে জাপান। তাই জাপানের প্রথম রাউন্ডের খেলার টিকেটই কেটেছিল আয়িশি, এখন স্টেডিয়ামে এর ওর কাছে জাপানের পরবর্তী রাউন্ডের ম্যাচের খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমনকি তার জাপানে ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট ছিল আজ, কিন্তু এখন সে ফ্লাইটের টিকেট বদলে কাতারে থাকবে বিশ্বকাপে জাপানের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত। আমি আয়িশির কাছে জানতে চাইলাম, বিশ্বকাপে জাপানের শেষ ম্যাচ কোনটা হতে পারে? আয়িশি চোখের কান্না মুছে হাসতে হাসতে আমাকে বললো, 'জাপান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলেও এখন আর অবাক হবো না!'
আয়িশি তো বলেছে জাপান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হলে সে অবাক হবে না, অন্যদিকে জাপানের সমর্থক ইয়ামোতো বলছে, এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে জাপান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হবেই! গ্রুপ পর্বে বিশ্ব ফুটবলের দুই জায়ান্টকে হারানোর পর জাপানি সমর্থকদের আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে গেছে তাদের মুখে এই কথা শুনে এখন আর কারোরই বাড়াবাড়ি মনে হবে না। খেলার মাঠে আমাদের বাংলাদেশিদের যত আবেগ আছে সব ক্রিকেট নিয়ে। কারণ বিশ্বমঞ্চে এই একটি খেলাতেই আমরা প্রথম সারির দলগুলোর একটি। বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে একটু ভালো খেলে, হঠাৎ হঠাৎ বড় দলকে হারিয়ে দেয় তখন হৃদয়ে জমে থাকা আবেগ প্রিয় দলকে নিয়ে কীভাবে কত বড় বড় স্বপ্ন দেখায় তা আমরা কিছুটা হলেও জানি। এই বিশ্বকাপেই কি জাপান বিশ্বকাপ জয় করতে পারবে?- ইয়ামোতোর কাছে এই প্রশ্ন করতেই সে চিৎকার করে বললো- স্পেন আর জার্মানিকে এক বিশ্বকাপে যে দল হারাতে পারে সেই দল অবশ্যই বিশ্বকাপ জেতার যোগ্যতা রাখে। এখনো পর্যন্ত এই বিশ্বকাপ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, জার্মানি আর বেলজিয়ামের মতো ফেভারিটরা যখন গ্রুপ পর্বের বাঁধা পেরোতে না পেরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে তখন কে যে এই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন সেই প্রেডিকশন আর করতে পারছে না কেউ!
গত বিশ্বকাপ থেকেই জাপানিরা বিশ্বকাপের সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। তবে সেটা জাপান দলের মাঠের খেলার জন্য নয়। খেলা শেষে জাপানি সমর্থকরা পুরো স্টেডিয়াম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিশ্ববাসীর নজর নিজেদের দিকে টেনে নেয়। এই বিশ্বকাপে আমি জাপানের দুটি খেলা দেখলাম। দুটি খেলাই ছিল দুই বড় দল জার্মানি আর স্পেনের বিপক্ষে। আমি টিকেট কেটেছিলাম জার্মানি আর স্পেনের খেলা দেখবো। অথচ আমাকে এবং আমার মতো অনেককেই অবাক করে দিয়ে দুই বড় দলকেই হারিয়ে দিলো জাপান।
এবারের বিশ্বকাপেও জাপানিরা খেলা শেষ হওয়ার একদল যখন আনন্দ উৎসবে মেতে আছে অন্যদল তখন শুরু করে দিয়েছে স্টেডিয়াম পরিষ্কার করার কাজ! এই কাজের শুরুটা করে ওরা ছোট ছোট গ্রুপ হিসেবে। তারপর দেখা যায় অনেক জাপানি সমর্থক যোগ দিয়েছে সেই ছোট ছোট গ্রুপের সাথে। কালও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জাপান ম্যাচ জেতার পর একদল জাপানি সমর্থক শুরু করে দিলো স্টেডিয়ামে পড়ে থাকা চিপস, পপ কর্ণ, স্যান্ডউইচ, বার্গার, কোমল পানীয় খেয়ে গ্যালারিতে দর্শকদের ফেলে রাখা সেইসব প্যাকেট বড় বড় ব্যাগে ভরতে। আমার পাশে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বার্সেলোনা থেকে আসা স্পেনের সমর্থক হাভিয়ের হাসতে হাসতে বললো- 'স্টেডিয়াম ক্লিন করতে করতে জাপানিরা এখন বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বড় দলগুলোকে ক্লিন করা শুরু করে দিয়েছে। এরপর জাপানের বিপক্ষে ম্যাচে কার যে কপাল পোড়ে!' শুধু জাপানিরাই নয়, অন্যদেশের সমর্থকরাও কালকের ম্যাচের পর জাপান ফুটবল দলকে সমীহ করতে শুরু করেছেন।
বিশ্বকাপে আসার পর এতদিন ম্যাচ জেতার পর ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা সমর্থকদেরকেই রাতভর কাতারে উৎসব করতে দেখেছি। কাল দেখলাম জাপানিদের নীল উৎসব। কাল ম্যাচ শেষে তারা দোহার খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের বাইরে এসে স্টেডিয়ামের বাইরের উন্মুক্ত এলাকাকে বানিয়ে ফেললো মিনি এক জাপান। নাচে গানে আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে তারা জমিয়ে রাখলো পুরো পরিবেশটাকে। জাপানিদের আনন্দ দেখে আমার তখন মনে পড়লো, বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এমন উন্মাতাল আনন্দই করেছিলাম আমরা। তাই উৎসবের রঙ ভিন্ন হলেও, আবেগটা যেন একইরকম। জাপানিদের খুশি দেখে ভালোই লাগছিলো এই কারণে এশিয়ার একটি দল গ্রুপ পর্বে বড় বড় দুই দলকে পেছনে ফেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার জন্য। আমরা তো এশিয়ারই মানুষ, আর যতই আমরা লাতিন ফুটবলের পূজারী হই না কেন- নিজেদের মহাদেশের দেশ জাপানের এমন অর্জনে এশিয়া মহাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের তো গর্বিত হওয়ারই কথা।
বিশ্বকাপের খেলা শুরু তিন ঘণ্টা আগে স্টেডিয়ামের গেট খোলা হয়। কিন্তু সমর্থকরা মাঠের বাইরে জড়ো হতে থাকেন ৫-৬ ঘণ্টা আগে থেকেই। আমিও প্রতিদিন আগে আগে মাঠে চলে যাই নানা দেশের সমর্থকদের সঙ্গে কথা হবে, নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা হবে এই লোভে। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে এসে নানা দেশ থেকে আসা মানুষ, নানা দেশের সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্কের যে সেতুবন্ধন বিশ্বকাপে তৈরি হয় সেটাও ফুটবল সমর্থকদের জন্য বিশ্বকাপের আসরে অনেক বড় একটি পাওয়া।
কাল যেমন স্টেডিয়ামের বাইরে আমার আড্ডা হলো আর্জেন্টিনার রোসারিও এর মেয়ে মেলিসার সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে খেলা দেখতে এসেছি এটা শুনেই মেলিসা চিৎকার করে বললো, জাপানের খেলা দেখতে কেন এসেছো, তোমরা তো দেখবে আর্জেন্টিনার খেলা! আমি বললাম, তুমিও তো জাপানের খেলা দেখতে এসেছো? তখন সে আমাকে বললো- টিকেট পেয়ে গেছি, তাই এসেছি। মেলিসা আমাকে জানালো আর্জেন্টিনার মানুষ এখন ভালো করেই বাংলাদেশকে চিনে। আর্জেন্টিনার ফুটবল নিয়ে আর্জেন্টিনার বাইরেও এমন একটা ফুটবল উন্মাদ জাতি আছে এটা নিয়ে প্রায়ই আর্জেন্টিনার গণমাধ্যেম সংবাদ প্রচার করা হয়। এখন তাই অনেক আর্জেন্টাইনই বাংলাদেশকে চিনে! মেলিসাকে আমি জাপানের খেলা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলাম- জাপানকে কেমন দল মনে হয়, ওরা কতটা শক্তিশালী? মেলিসা আমাকে বললো- 'বিশ্ব ফুটবলের শক্তির বিচারে জাপান একটি মাঝারি মানের দল। তবে এশিয়ার মধ্যে জাপানই একমাত্র ধারাবাহিক দল যারা প্রতিটি বিশ্বকাপে খেলছে আর প্রতিনিয়ত ভালো করছে। এশিয়ার কোনো দল যদি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় তাহলে জাপানই হবে প্রথম দল।'
আর্জেন্টিনার মেয়ে মেলিসার মতো জাপানিরাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে একদিন বিশ্বকাপ ফুটবল জিতবে জাপান। কালকে স্পেনকে হারানোর পর জাপানি সমর্থকদের সেই বিশ্বাস রূপ নিলো আত্মবিশ্বাসে। জাপানি সমর্থকরা এখন স্বপ্ন দেখছে বিশ্বকাপ জয়ের! আর সেটা এই বিশ্বকাপেই...
Comments