প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় এবার শাবিপ্রবি শিক্ষার্থী সজলের একার প্রতিবাদ

দাবি আদায়ে এবার একাই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন সজল। ছবি: শেখ নাসির

সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার করার প্রায় ৭ মাস হতে চললেও প্রতিশ্রুত দাবি পুরণ না হওয়ায় এবার ৩ দফা দাবি নিয়ে একাই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজল কুণ্ডু।

উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি এম ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনের সামনে পুলিশের ছররা গুলির ধাতব টুকরো শরীরে বিঁধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন সজল। এখনো তিনি তার শরীরে ৮০টি ধাতব টুকরো বয়ে বেড়াচ্ছেন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে সজল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে প্ল্যাকার্ডে লেখা তার ৩ দফা দাবি নিয়ে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল পর্যন্ত একাই দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন।

সজলের দাবিগুলো হলো—বর্তমান এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের নামে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা, শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের প্রতিনিধিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করা এবং তার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া কাজ ফিরিয়ে দেওয়া।

১৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার পর শাবিপ্রবির ২০০ থেকে ৩০০ অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এছাড়া আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের অর্থসাহায্য করায় ৫ জন সাবেক শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও দেড়শ জন সাবেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়।

আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে পুলিশের গুলিতে আহত সজল কুণ্ডকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ কোটি টাকা এবং নবম গ্রেডের একটি সরকারি চাকরির দেওয়ার দাবি ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অন্যান্য দাবির পাশাপাশি এ দাবিও পূরণ হয়নি।

আহত হওয়ার আগে সজল কুণ্ডু আইআইসিটি ভবনের ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। তার দাবি, নিয়মের দোহাই দিয়ে প্রশাসন এই তার কাছ থেকে এই দায়িত্বও কেড়ে নিয়েছে।

সজল জানান, পিতৃহীন পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম। তার ব্যক্তিগত ও পরিবারের সঞ্চয় নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনা শুরু করেছিলেন। এই কাজটি কেড়ে নেওয়ায় তিনি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সজল কুণ্ডু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি আমার এই ৩ দফা দাবি শাবিপ্রবির বর্তমান ও সাবেক সব শিক্ষার্থীর দাবি। অবিলম্বে আমার এই ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হোক।'

গত ৫ দিন ধরে সজল তার দাবি নিয়ে দাঁড়ালেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সরকারের কোনো পর্যায় থেকে তার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানান তিনি। তবে তার অভিযোগ, তার নিয়মিত এই প্রতিবাদ কর্মসূচি প্রত্যাহারে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে শাবিপ্রবির ছাত্র কল্যাণ ও উপদেশ কেন্দ্রের পরিচালক আমিনা পারভীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তার (সজল) প্রতিবাদ কর্মসূচির বিষয়ে অবগত আছি। কিন্তু তার দাবিগুলোর কোনোটিই আমার এখতিয়ারভুক্ত না হওয়ায় আমি কিছু বলতে পারছি না।'

শাবিপ্রবির রেজিস্ট্রার মো. ইশফাকুল হোসেন বলেন, 'প্রতিশ্রুত দাবির ব্যাপারে এখনো কোন সিদ্ধান্ত না আসায় আমাদের দিক থেকে কিছু করার নেই। মামলাসংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রক্টরিয়াল বডির এখতিয়ার আর ক্যাফেটেরিয়ার বিষয়টি দেখবেন আইআইসিটি ভবনের দায়িত্বশীলরা।'

মামলা প্রত্যাহারের দাবির বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. ইশরাত ইবনে ইসমাইলের মোবাইলে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

সজলের কাছ থেকে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে আইআইসিটির (ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি) পরিচালক অধ্যাপক এম জহিরুল ইসলামের ভাষ্য, 'মৌখিকভাবে তাকে (সজল) ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বে থাকা আগের সবাই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সে (সজল) যখন তার বিভাগের একজন শিক্ষকের সুপারিশ নিয়ে আমার কাছে আসে, তখন তাকে ট্রায়াল বেসিসে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়; সে এটা লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে পারবে কিনা এবং খাবারের মানে আমরা সন্তুষ্ট কি না তা বোঝার জন্য।'

জহিরুল ইসলাম আরও বলেন, 'সে প্রথমে আমাকে জানিয়েছিল যে তার (সজল) পড়াশোনা শেষ। কিন্তু সে তখনো শিক্ষার্থী ছিল। গত এপ্রিলে তার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এছাড়া ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার ট্রেড লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্রও ছিল না, যা সে গত এপ্রিলে করেছে।'

আইআইসিটি পরিচালকের বক্তব্য, 'জানুয়ারির অচলাবস্থার পর আমরা ক্যাফেটেরিয়ার সংস্কারকাজের উদ্যোগ নেই। তাকে (সজল) বলেছি যে, সংস্কার শেষ হলে আমরা টেন্ডার আহ্বান করব। তখন বিধি মোতাবেক যদি সে বরাদ্দ পায়, তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।'

উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের পূর্বাপর

গত ১৩ জানুয়ারি শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ওই হলের আবাসিক ছাত্রীরা। ১৫ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে ছাত্রলীগের একাংশ ও প্রশাসনিক কর্মচারীরা।

পরদিন সকাল থেকে আবারও আন্দোলনে নামেন ছাত্রীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সেদিন এই আন্দোলনে যুক্ত হন।

সেদিন বিকেল ৩টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তার কার্যালয় থেকে বের হয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে যাওয়ার পথে তার পথ আগলে দাঁড়ান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা তাদের দাবিগুলোর বিষয়ে কথা বলতে চান।

এক পর্যায়ে উপস্থিত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপাচার্যকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে প্রবেশ করেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভবনের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে দেন।

দুপুর ২টার দিকে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। উপাচার্যকে আইআইসিটি ভবন থেকে বের করতে পুলিশের ক্রিটিক্যাল রেসপন্স টিমের (সিআরটি) ইউনিটও পৌঁছায় ক্যাম্পাসে।

বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবরুদ্ধ ভবনের তালা খোলার বিষয়ে এবং দাবিগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য কথা বলতে যান শিক্ষকরা।

আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন বলে দাবি করেন আন্দোলনকারীরা।

এ ছাড়া ১০ পুলিশ সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম এবং ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ আহত হন বলে জানায় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ পর্যায়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাতেই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির কাছে খোলা চিঠি লিখেন শিক্ষার্থীরা। পরদিন সেই চিঠি ডাক বিভাগের মাধ্যমে বঙ্গভবনে পাঠানো হয়।

১৯ জানুয়ারি বিকেল থেকে থেকে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী।

এর মধ্যে ১ জন শিক্ষার্থী বাবার অসুস্থতার কারণে অনশন ত্যাগ করেন এবং আরও ৫ শিক্ষার্থী অনশনে বসেন।

২৬ জানুয়ারি ভোররাতে ক্যাম্পাসে আসেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হক। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে, এমন বার্তা নিয়ে আসেন তারা। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ১৬৩ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙেন ২৮ শিক্ষার্থী। তবে আন্দোলন চালিয়ে যান তারা।

১১ ফেব্রুয়ারি সিলেটে আসেন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সব দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন এবং উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আশ্বাস দেন।

পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা একটি সাধারণ সভা শেষে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago