ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল চালায় ছাত্রলীগ

বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসন নয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে প্রথম বর্ষের কোন শিক্ষার্থী উঠবেন তা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেতারা।

বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসন নয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে প্রথম বর্ষের কোন শিক্ষার্থী উঠবেন তা নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের নেতারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি ছাত্রাবাসে মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আসন রয়েছে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, হল সংকটের এই অযাচিত সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের 'গণরুমে' থাকার অনুমতি দেয়। বিনিময়ে ওই শিক্ষার্থীদের ছাত্রলীগের রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে বলে জানিয়েছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা।

লালন শাহ হলের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'শিক্ষার্থীরা আন্দোলন তো দূরের কথা ছাত্রলীগের ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলারও সাহস পায় না।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, 'আসন সংকট এবং ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য অপরাধের বিষয়গুলো পারস্পরিক সম্পর্কিত।'

তিনি বলেন, 'হল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা যথাযথভাবে নিজেদের ভূমিকা পালন না করায় শিক্ষার্থীদেরকে আসন পাওয়ার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা চাহিদা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সিটও পান না। ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। নেতারা তাদের সংগঠনের জন্য তাদের ব্যবহার করেন।'

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এক শিক্ষার্থীকে হয়রানির ঘটনার পর হলে শিক্ষার্থীদের থাকার অনুমতি দিতে ছাত্রলীগের বিষয়টি সামনে আসে।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতিত করেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুলপরী অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী, কর্মী তাবাসসুম ইসলামসহ আরও কয়েকজন 'অনুমতি ছাড়া' হলে থাকার কারণে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে তাকে নির্যাতন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পাবনার বাসিন্দা ফুলপরী 'অনুমতি' ছাড়াই 'অতিথি' হিসেবে হলে রয়েছেন জেনে ক্ষিপ্ত হন ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা।

হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শামসুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফুলপরী হলে অবস্থান করছেন তা তিনি জানতেন না।

একজন নতুন শিক্ষার্থীকে হলে থাকতে বা আসন পেতে ছাত্রলীগের অনুমতি লাগবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখানে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই। হল প্রশাসনই আসন বরাদ্দ করে।'

তিনি বলেন, এটা স্বাভাবিক যে প্রথম বর্ষের অনার্সের শিক্ষার্থীরা তাদের চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষে সিট পাবে কিংবা দ্বিতীয় বর্ষে উঠলে আসন বরাদ্দ হবে।

১৯৮০ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ৫ হাজার ১৭২ জন নারী শিক্ষার্থীসহ মোট ১৫ হাজার ৮৯৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ৩টিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৮টি হল রয়েছে।

৮টি হলে মোট ৩ হাজার ২৮২টি আসন থাকলেও বর্তমানে ৪ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৫০ জন। কিন্তু সেখানে প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী থাকছেন। হলের প্রার্থনা কক্ষে অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকেন। এই হলে ৯টি 'গণরুম' রয়েছে।

লালন শাহ হলের 'গণরুমে'র এক শিক্ষার্থী জানান, তার কক্ষে ১৭ জন শিক্ষার্থী থাকেন। তারা সেখানে ঠিকমতো পড়তে পারেন না।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সভাপতি ইমানুল সোহান বলেন, 'এই গণরুমগুলো ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত। আমরা ছাত্রলীগের অনুমতি ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে আসন পেতে দেখিনি।'

বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, 'অনেক শিক্ষার্থী হলে সিট না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ১ ঘণ্টার দূরত্বে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। শিক্ষার্থীদের বাসা ভাড়া দিতে অভিভাবকদের খরচও বেড়ে যায়।'

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিক আরাফাত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, তারা কখনই কোনো 'গণরুম' বা হল নিয়ন্ত্রণ করেন না।

তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনের তীব্র সংকট রয়েছে। কুষ্টিয়ার বাইরের কোনো শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কখনো কাউকে আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করি না।'

উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম বলেন, 'নতুনদের জন্য হলে আসন পাওয়া সত্যিই কঠিন। আমি যতদূর জানি, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলে আসন বরাদ্দ পান।'

তিনি জানান, ৪টি নতুন হল নির্মাণের কাজ চলছে। এর কাজ শেষ হলে আবাসন সংকট অনেকটা লাঘব হবে। এর প্রতিটিতে ১ হাজার শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা হবে।

ছাত্রলীগের 'গণরুম' নিয়ন্ত্রণ করা এবং শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। হল প্রশাসনকে অনেকের সঙ্গে কাজ করতে হয়। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলে শৃঙ্খলা বজায় রাখা।'

Comments