রবীন্দ্রনাথের নায়িকারা

রবীন্দ্রনাথ যে সমাজকে নিয়ে লিখেছেন, সেখানে পুরুষের আধিপত্য ছিল অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। ওদিকে পুরুষ নিজেও যে স্বাধীন ছিল তা নয়, পুরুষ ছিল উপনিবেশের বাসিন্দা, ঔপনিবেশিক শাসন বড় নির্মমভাবে সংকুচিত করে দিয়েছে পুরুষের কর্মক্ষেত্রটিকে। এই পুরুষের অধীনে যে নারী, সে আসলে বন্দির হাতে বন্দি, তার জন্য কর্মের বৃহৎ ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ বা অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।
painting_robi.jpg

রবীন্দ্রনাথ যে সমাজকে নিয়ে লিখেছেন, সেখানে পুরুষের আধিপত্য ছিল অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। ওদিকে পুরুষ নিজেও যে স্বাধীন ছিল তা নয়, পুরুষ ছিল উপনিবেশের বাসিন্দা, ঔপনিবেশিক শাসন বড় নির্মমভাবে সংকুচিত করে দিয়েছে পুরুষের কর্মক্ষেত্রটিকে। এই পুরুষের অধীনে যে নারী, সে আসলে বন্দির হাতে বন্দি, তার জন্য কর্মের বৃহৎ ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ বা অংশগ্রহণ করা সম্ভব ছিল না।

আমাদের পেছনের ইতিহাসটা যেমন পরাধীনতার, তেমনি কর্মসংকোচনেরও বটে। তারপর একাধিকবার তো স্বাধীন হলাম আমরা; কিন্তু প্রসারিত হয়েছে কি কর্মের স্বাধীনতা, নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে বেকারের সংখ্যা এবং কর্মজীবী নারীর জন্য লাঞ্ছনা? হিসাবটা বড় নির্ভুল, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য যেদিকে ইশারা তুলে ধরে, সমাজতত্ত্বও সেই সত্যকেই উপস্থিত করে পরিসংখ্যান ও প্রমাণের সমর্থন নিয়ে। স্বাধীনতা কেবলি পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

নারীর দ্বৈত চরিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিটি সবারই জানা। মেয়েদের তিনি দুই জাতের বলে মনে করেন; এক জাত প্রধানত মাতা, অন্য জাত প্রধানত প্রিয়া! 'দুই বোন' উপন্যাসের শুরুতেই লেখক বলেছেন ওই দুই জাতের বিশিষ্টতা সম্পর্কে। তার মতে, মা যেন বর্ষা ঋতু, 'জলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, ঊর্ধ্বলোক থেকে আপনাকে দেন বিগলিত করে, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব।'

অন্যদিকে, প্রিয়া যেন বসন্ত ঋতু, 'গভীর তার রহস্য, মধুর তার মায়াতন্ত্র, তার চাঞ্চল্য রক্তে তোলে তরঙ্গ, পৌঁছায় চিত্তের সেই মণিকোঠায়, যেখানে সোনার বীণায় একটি নিভৃত তার রয়েছে নীরবের ঝঙ্কারের অপেক্ষায়, যে ঝঙ্কারে বেজে ওঠে সর্বদেহমনে অনির্বচনীয় বাণী।'

'দুই বোন'র পৃথিবীতে যারা শর্মিলা ও ঊর্মিমালা, 'বলাকা'র স্বর্গে তারাই ঈশ্বরী ও অপ্সরী। কিন্তু, আরও প্রাথমিক স্তরে একটি পার্থক্য স্বীকার করেন রবীন্দ্রনাথ। সেটি পুরুষ ও নারীর। তারা এক নয়, স্বতন্ত্র্য। পুরুষ হচ্ছে বাইরের, স্ত্রী ঘরের। রবীন্দ্রনাথের এই দুই মতের কোনটিতে অবশ্য অভিনবত্ব নেই। কিন্তু তার উপস্থাপনায় বক্তব্য একেবারে নতুন করে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।

অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে রবীন্দ্রনাথের জগতে প্রকাশ্য আধিপত্য যেটা, সেটা সব সময়ই পুরুষের। যদি তা না হতো, তবে তার রচনা বাস্তবিক নয়, অবাস্তবিক হতো; তাতে ইতিহাস থাকত না। পুরুষই কর্তা, কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিশিষ্ট, তা হচ্ছে নারীকে জিতিয়ে দেওয়ায়। পুরুষই কর্তৃত্ব করে, বন্দি করে রাখে, সংকুচিত করে দেয় নারীর কর্মক্ষেত্র; কিন্তু পুরুষ আবার হেরে যায়। খুব সাদামাটাভাবে ঘটে না ঘটনাটা, যেমনটা ঘটেছে।

'স্ত্রীর পত্র'র মৃণালের হবার কথা ছিল বড়জোর ওই মালতীর মতোই। পূর্ববঙ্গের গরিব ঘরের মেয়ে, পড়ালেখা কিছু আছে, দরখাস্ত লিখতে পারত শরৎচন্দ্রের কাছে। তা তো লিখছে না। লিখছে বরঞ্চ চিঠি, স্বামীর অভিমুখে।

'শ্রীচরণকমলেষু' দিয়ে শুরু বটে, কিন্তু ঘোষণা বড় স্পষ্ট; 'এ তোমাদের মেজো বউয়ের চিঠি নয়।' মৃণালের স্বামী ২৭ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে স্থায়ী অধিবাসী। মৃণাল সেখানে ফেরত যাবে না। মৃণালের স্বামী কলোনির বাবু, অফিসের কর্মচারী, শামুকের সঙ্গে খোলসের যেমন সম্পর্ক তেমনি তার সম্পর্ক অফিসের সঙ্গে, একেবারে দেহমনের সঙ্গে সেঁটে যাওয়া।

সেই বন্দিরা সদলবলে বন্দি করেছিল মৃণালকে তাদের একান্নবর্তী পরিবারের দেয়ালঘেরা চৌহদ্দিতে। ওই বাড়ির বড় বউয়ের রূপের অভাব মেজো বউকে দিয়ে পূরণ করার চেষ্টা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল, মৃণাল তেমনি থাকবে যেমন অন্য বউরা থাকে। কিন্তু সে তা রইল না, মেজো বউয়ের খোলসের ভেতর থেকে মৃণাল নামের মেয়েটি বের হয়ে এলো। অভাগা অনাথিনী বিন্দুর আত্মহত্যার ঘটনা যাকে বলে দিল কী করতে হবে। সে চলে গেছে তীর্থে, শ্রীধামে। সেখান থেকে চিঠি লিখছে—বিজয়ের।

কোনো দিক দিয়েই রবীন্দ্রনাথের এই মৃণাল ইবসেনের নোরা নয়। নোরা আরও আগের ঘটনা; ঊনবিংশ শতাব্দীর। কিন্তু, আগের হলেও নোরা হচ্ছে স্বাধীন দেশের মেয়ে, মৃণালের জন্ম ও বিকাশ পরাধীন বাংলায়। নোরার গৃহত্যাগ যে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করেননি, এমন প্রমাণ তার লেখায় আছে; কিন্তু তার মৃণালও তো নোরার কাজটাই করছে, ত্যাগ করেছে গৃহ। দুই জনই স্বাধীনতা খোঁজে, কিন্তু দুই জনের পথ এক নয়। গৃহত্যাগের কারণ যে অভিন্ন তাও নয়।

নোরা তীর্থে যায়নি, শহরেই থাকবে বলে আমাদের অনুমান, জীবিকার ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। অর্থকরী কাজ করার শক্তি যে তার আছে আমরা তা জানি। মৃণালকে কিন্তু যেতে হয় তীর্থে, তাকে আশ্রয় নিতে হবে কোনো ধর্মমন্দিরে।

সে যে পরাধীন দেশের মেয়ে, তার পক্ষে তো সম্ভব নয় খাঁটি বুর্জোয়া হওয়া। নোরা গৃহত্যাগ করেছে এই পুঁজিবাদের অধীনে স্বামীর নোংরা চেহারাটা দেখে; মৃণালের বিদ্রোহ বিন্দুর ওপর সামন্তবাদী নিপীড়ন দেখে এবং তার ভরসাটাও আবার ওই সামন্তবাদের কাছেই, তীর্থস্থানে। বেচারা যাবে কোথায়, যাওয়ার জায়গা কোথায়? যার থেকে আঘাত পায় ঘুরেফিরে তার কাছেই আশ্রয় চায়।

এটাও সত্য যে মৃণাল ঘর ছাড়তে পেরেছে তার সন্তান নেই বলেই। কিন্তু, তবু মৃণাল বিজয়ী। পতাকা ওড়ায়নি তবে ঠিকই বিদ্রোহ করেছে।

গোরা অবশ্য আলাদা মাপের পুরুষ। পরাধীন নয় সে। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, ভয়ংকরভাবে জাতীয়তাবাদী। ইংরেজ ও ইংরেজদের কর্মচারী উভয়ের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে এবং সে জেলও খাটে।

গোরার মতো প্রবল পুরুষ রবীন্দ্রসাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। আত্মপরিচয়ের রূঢ় বাস্তবতাটা যখন ভূমিকম্প ঘটিয়ে বের হয়ে পড়ে, ব্রাত্য গোরা তখন যাবে কোথায়, কার কাছে? যায়, যেতে হয় ওই মায়ের কাছেই। মাতা আনন্দময়ীর কাছে নিতান্তই একটি শিশু; আনন্দময়ী তার মা নয়, প্রতিপালক মাত্র। কিন্তু আনন্দময়ীর কাছে গোরা অবুঝ-অস্থির পলায়নপর সন্তান ছাড়া আর কিছুই নয়; যেতে হয় সুচরিতার কাছেও, যে প্রেয়সী হলেও উর্বশী নয়, মাতার মতোই আশ্রয়দাত্রী। আনন্দময়ী যে অনেক বড় সে খবর আমরা আনন্দময়ীর নিজের আচরণেই পাই। পাই বিনয়ের স্বীকারোক্তিতেও।

বিনয় বলছে তাকে, 'মা তোমাকে যতই দেখছি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। তোমার মন এমন সাফ হলো কি করে। তোমাকে কি পায়ে চলতে হয় না- ঈশ্বর তোমাকে কি পাখা দিয়েছেন। তোমার কোনো জায়গায় কি ঠেকে না।' এবং পরে নিজের কথা বলছে সে 'কিন্তু মা, আমি মুখে যাই বলি মনটাতে ঠেকে যে। এত যে বুঝিসুঝি, পড়িশুনি, তর্ক করি, হঠাৎ দেখতে পাই মনটা নিতান্তই মূর্খ রয়ে গেছে।'

মূর্খ থাকার কথা ছিল বরং আনন্দময়ীরই। কৃষ্ণদয়ালের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তিনি, নিঃসন্তান, উচ্চশিক্ষা পাননি। কিন্তু, তিনি ছাড়িয়ে যান সাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করে ধনী হওয়া স্বামী কৃষ্ণদলায়কে, সাহেব বাবা-মার সন্তান গোরাকে, উচ্চশিক্ষিত বিনয়কে। আনন্দময়ীর মধ্যে প্রবলতা নেই, নেই তা সুচরিতার ভেতরও; কিন্তু জয়ী হয় তারা উভয়েই।

'যোগাযোগ'র রাজা মধুসূদনের সংস্কৃতি, সভ্যতা বলে কোনো কিছু নেই। উপনিবেশের সফল ব্যবসায়ী সে; স্থূল, কর্কশ, মাংসলোলুপ। একেবারেই মিল নেই গোরার সঙ্গে। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, এসব ব্যাপারে বক্তৃতা করবে, এমনটা আশা করার কোনো হেতু নেই তার কাছ থেকে। কিন্তু, তার প্রবলতাকে যে অস্বীকার করব, তারও তো জো নেই। কুমুকে ছিনিয়ে এনে ক্ষুদ্রাকৃতির এই বনমানুষটি বন্দি করে রেখেছে রাজপ্রসাদের অপ্রশস্ত গণ্ডিতে। তবে কুমুকে যতই পীড়িত করেছে ততই কিন্তু হেরে গেছে সে-ওই কুমুর কাছেই।

কুমুর জন্য বন্ধন এই ব্যবসায়ী; কিন্তু কুমুর চেয়ে খাটো সে প্রায় সব দিক দিয়ে। তার জোর একটাই, টাকার। অন্ধকার যেমন আলোকে উজ্জ্বল করে, তেমনি তার আঁধার দীপ্যমান করে তোলে কুমুকে। কিন্তু, কুমুকে মুক্তি দিতে পারেনি তার শ্রদ্ধাভাজন ভ্রাতা বিপ্রদাসও।

বিপ্রদাসের অক্ষমতাই কুমুর বন্দিত্বের প্রকৃত কারণ। বিপ্রদাস বা মধুসূদন উভয়েই পরাভূত কুমুর কাছে। কুমু মৃণাল নয়, বিদ্রোহ করে না, সে মালতী নয়, দরখাস্ত লেখে না, নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে সহ্যক্ষমতার আলো জ্বেলে সে ধরিয়ে দেয় তার স্বামী কেমন সামান্য, ভ্রাতা কেমন অসমর্থ।

স্বামী মধুসূদন রজনীগন্ধার ঝাড়টাকে এনেছে ছিন্ন করে, ভাই বিপ্রদাস সেটিকে রক্ষা করতে পারেনি। বিপ্রদাসরা জমিদার বংশ, তারা পুরনো রাজা, এখন পড়তির দলে, সেই জন্য তারা দুর্বল, ব্যবসায়ী বংশ এখন নতুন রাজা, তারা উঠেছে। সে জন্য তারা প্রবল; কিন্তু দুইয়ের কেউই যোগ্য নয় শান্ত কুমুর অভিভাবক হওয়ার। উপনিবেশের জমিদার ও ব্যবসায়ী উভয়ই উপনিবেশের জাতীয়তাবাদীর মতোই হাতে-পায়ে বাঁধা।

দামিনী কুমুর তুলনায় অশান্ত। দামিনী বিধবা, স্বামী ছিল ভক্তির রাজ্যের বিনীত প্রজা, দামিনী তা নয়। সে বিদ্রোহিনী, তার নিজের মতো করে। তার আচরণ মোটেই হিন্দু বিধবার মতো নয়; স্বামীর সহযোগীরা এখন তার অভিভাবক। তাদের সে বলে, আমরা শুনি, 'তোমাদের ভক্তরা যে এই ভক্তিহীনাকে ভক্তির গারদে পায়ে বেড়ি দিয়া রাখিয়াছে। তোমরা কি আমার আর কোনো রাস্তা রাখিয়াছ।'

দামিনী নিজে জ্বলছে, সে অন্যদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। সচীশের প্রতি তার বিশেষ দৃষ্টি। সচীশই সবচেয়ে বড় মাপের মানুষ, দামিনীর অভিভাবকদের মধ্যে। সে একটি জ্যোতিষ্ক, তার আছে আভা। শেষ পর্যন্ত দামিনীর বিয়ে হলো শ্রীবিলাসের সঙ্গে। কিন্তু, শ্রীবিলাসকে তো সে চায়নি। দামিনী শোধ নিল সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে। অমিত রায়কে চেনা যায় তার বাক্যবিন্যাসে। সব সময়ই সে বিদ্যুতের মতো দীপ্ত এবং সর্বদাই প্রস্তুত।

ভাবতে অবাক লাগে যে 'শেষের কবিতা' ও 'যোগাযোগ' একই বছরে লেখা; কেননা, তারা একে অপর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র্য। অমিত মধুসূদন নয়, যেমন লাবণ্য নয় কুমু। অমিত ব্যবসায়ী নয়, ব্যারিস্টার। তার আছে কল্পনা, তার আছে বিদেশি সাহিত্যে অগাধ উৎসাহ ও পাঠ। সে কবিতা লিখতে জানে, মোটরগাড়ি চালায়, অনায়াসে জয় করে নেয় যেকোনো মানুষের হৃদয়। কলকাতার ছেলে কিন্তু অধিকতর স্বাভাবিক সে অক্সফোর্ডে ও শিলঙে।

অমিত সাহেবের সন্তান গোরা থেকেও স্বতন্ত্র্য; সে একেবারেই জাতীয়তাবাদী নয়, বরং আন্তর্জাতিক। কিন্তু, সব কিছু সত্ত্বেও, না মেনে উপায় কী যে সেও কলোনিরই বাসিন্দা। তার স্ফূর্তি বাক্যে, তার জগৎ কর্মের দিক থেকে সংকীর্ণ। গায়ে গন্ধ নেই সংস্কারের ও ধর্মবাদিতার; কিন্তু সুগন্ধি রয়েছে ইংরেজিপ্রীতির। কাজ নেই, প্রেম করে বেড়ায়। দায় নেই অর্থোপার্জনের, চলে পূর্বপুরুষের অনার্জিত আয়ে। কেটি-লিজিদের সমাজেরই মানুষ সে। অমিত পরিণত বয়সের বালক একজন।

তার কাছে হেরে যাবে লাবণ্য। যেতেই হবে। কী আছে ওই মেয়ের? আশ্রয়টুকু পর্যন্ত নেই। শিলঙে এসেছে চাকরি নিয়ে, থাকে অন্যের বাড়িতে। তাকে গভর্নেস বললে রূঢ় শোনাবে কিন্তু মিথ্যা বলা হবে না। তার উত্তরাধিকারের বৈষয়িক আনুকূল্য নেই, বাবার সম্পত্তি নেয়নি সে।

লাবণ্য কী করে পাবে অবাধ চলাফেলার সুযোগ ও অধিকার? ওই অমিত, ব্যারিস্টার ও অভিজাত অমিস্ট্রায়, লাবণ্যকে বিয়ে করবে কেন? এ বিয়ে অসম হতো। যেন দর্পণ একটি, এই দেখ অমিত, তুমি যতই যা বলো, প্রেমের কথা, সংস্কৃতির কথা, তুমি আসলে তোমার শ্রেণি ও সমাজেরই একজন। তুমি বিয়ে করবে কেটিকেই, অক্সফোর্ডে থাকার সময় যার আঙুলে তুমি আংটি পরিয়ে দিয়েছিলে। লাবণ্য অবশ্যই প্রেয়সী, কিন্তু মোটেই লেলিহান নয়, সে শান্ত, তার আছে মায়ের গুণ।

অমিত যতই যা ভাবুক, অমিত উপযুক্ত নয় লাবণ্যের জন্য। লাবণ্যের কাছে হেরে যায় লাবণ্যের পিতাও। পিতা অবনীশ দত্ত একজন মহৎ পুরুষ। বড় মাপের গবেষক তিনি, ছিলেন পশ্চিমী কলেজের অধ্যক্ষ। মাতৃহীন লাবণ্যের প্রতি তার মমতার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু, অতর্কিতে তিনি বিয়ে করে ফেললেন, লাবণ্যকে অবিবাহিত রেখেই।

লাবণ্য বুঝেছে পিতার আগ্রহ, সে নিজেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে পিতৃপরিণয়ের সব কিছুর এবং সম্পত্তির ভাগ নেয়নি। সহপাঠী শোভনলালের যদি সাহস থাকত ডাক দেওয়ার, তাহলে অবশ্যই সাড়া দিত লাবণ্যলতা। কিন্তু, শোভনলাল সে সাহস কোথায় পাবে? তার বাবা থাকে গ্রামে, তার শিক্ষালাভ ঘটেছে ছাত্রবৃত্তির টাকায়। গবেষক হিসেবে বড় হতে পারে; কিন্তু পরনির্ভরশীলতাটা ঘোচে না।

ফরাসি দেশের পন্ডিতদের সঙ্গে যে যোগাযোগ করবে, তার জন্য সাহায্য চাইতে হয় তাকে অমিতের কাছে। লাবণ্যের জন্য উপযুক্ত তাকে বলি কি করে? শোভনলালকে তো অবশ্যই, লাবণ্য যে হারিয়ে দেয় অমিতকেও সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়।

বিশাল রবীন্দ্র সাহিত্যের স্বল্প পরিসরের বিশ্লেষণে ঘটনাটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে নারী যে পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র্য রবীন্দ্রনাথ সেটা খুবই মানেন। তারা যে পরস্পরের পরিপূরক, এটাও অস্বীকার করেন না। কিন্তু, যা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, নারী-পুরুষের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তিনি সর্বদাই লক্ষ্য করেছেন, তা সে নারী মাতাই হোক কী প্রেমিকাই হোক কিংবা হোক দুয়ের সংমিশ্রণ।

এই দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে দেখা গেছে পুরুষই আধিপত্য করে—স্বামী, প্রেমিক, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু-নানা ভূমিকায়; কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ জেতে না, শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় নারীই। আর ওই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে পুরুষ নিজেও যে বন্দি নানা ব্যবস্থার হাতে, সে সত্যটা উন্মোচিত হয়ে যায়। মেয়েরা জয়ী হয়, কেননা তারা প্রতিনিধিত্ব করে সৃষ্টির, প্রকৃতির ও স্বাভাবিকতার। নীরব পক্ষপাতিত্ব নারীর পক্ষেই।

Comments