কেজিতে দাম কমেছে ৩০০-৭০০ টাকা, চিংড়ি চাষে বিপর্যয়

দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান চিংড়ি শিল্পের। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই আসে খুলনা অঞ্চলের ৪ জেলা থেকে। করোনাকালে চিংড়ি রপ্তানি প্রায় বন্ধ ছিল। সংকটে ছিলেন রপ্তানিকারকরা।
চিংড়ি চাষে বিপর্যয়
খুলনার দাকোপ উপজেলার ঘোনা গ্রামে চিংড়ি বাছাই করছেন চাষিরা। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান চিংড়ি শিল্পের। দেশের মোট উৎপাদিত চিংড়ির সিংহভাগই আসে খুলনা অঞ্চলের ৪ জেলা থেকে। করোনাকালে চিংড়ি রপ্তানি প্রায় বন্ধ ছিল। সংকটে ছিলেন রপ্তানিকারকরা।

করোনার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার মধ্যেই এবার দাম বিপর্যয়ের সংকটে পড়েছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা। এ অবস্থায় সরকারের বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব বলে জানিয়েছেন চিংড়ি চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

চিংড়ি চাষিদের অভিযোগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এ ক্ষেত্রে কোনো সহায়তা তাদের দিচ্ছে না, বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণও করছে না।

চাষিরা বলছেন, গত ২ মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে 'সাদা সোনা' নামে পরিচিত চিংড়ির দাম ব্যাপকহারে কমেছে। ২ মাসের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দাম কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের হাজারো চিংড়ি চাষির অবস্থা এখন শোচনীয়।

হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কম দামে চিংড়ি কিনে সংরক্ষণ করছে। তবে স্থানীয় বাজারে চাহিদা থাকায় ছোট আকারের চিংড়ির দাম তুলনামূলক বেশি।

খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস চিংড়ি চাষ। ১৯৮০-র দশকে থেকে খুলনা এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে লবণাক্ত পানিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ ইউরোপসহ বিশ্বের ৩২টি দেশে রপ্তানি হয়।

সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মাছের খাদ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি পোনার দাম বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য কারণেও একসময়ের সম্ভাবনাময় এ শিল্প এমনিতেই চরম সংকটে আছে।

চিংড়ি চাষে বিপর্যয়
ঘোনা গ্রামে চিংড়ি বাছাই। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার চকশৈলমারী গ্রামের আধা নিবিড় চিংড়ি চাষি বিপ্রদাস বৈরাগী (৪৪) গত ৭ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছেন। ৫০ শতাংশ জমির পুকুরে চিংড়ি চাষ করেছেন তিনি।

বিপ্রদাস গত বছর ১২ লাখ টাকার চিংড়ি বিক্রি করেছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে প্রতি কেজি চিংড়ি (কেজিতে ১৮-২০টি) ১,২০০-১,৩৫০ টাকায় বিক্রি হলেও, এখন তিনি চিংড়ি বিক্রি করছেন ৭১০-৮৩০ টাকায়।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত সেপ্টেম্বরের পর ২ মাসের ব্যবধানে চিংড়ির দাম অনেক কমেছে। এখন ছোট আকারের চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকায়। মাঝারি আকারের চিংড়ি ৭৩০-৮০০ টাকায়।'

'বড় আকারের (কেজিতে ১২-১৫টি) চিংড়ি ৮৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি, যা আগে বিক্রি করেছি ১,৫০০-১,৬৮০ টাকায়,' যোগ করেন তিনি।

বিপ্রদাস জানান, বর্তমানে ব্যবসায়ীরা পুকুর থেকে চিংড়ি কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাই কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। 'ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চিংড়ির বাজারে কারসাজি করে ছোট চাষিদের কম দামে চিংড়ি বিক্রি করতে বাধ্য করছে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার মতে, 'সরকারের চিংড়ি কেনার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো এমন লোকসানে পড়তে হতো না। চিংড়ি শিল্প পুরোটাই বেসরকারি সিন্ডিকেটের দখলে। সরকারের নিজস্ব বিপণন ব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে সিন্ডিকেট জায়গা করে নিতে পারত না।'

বিপ্রদাস জানান, গত বছরের মে মাসে ৩ হাজার ৬০০ টাকায় তিনি চিংড়ির জন্য ২৫ কেজির ১ বস্তা ফিড কিনেছিলেন। একই ফিড এ বছর কিনতে হচ্ছে ৪ হাজার ৩২৫ টাকায়।

অর্থাৎ, প্রতি কেজিতে ফিডের দাম বেড়েছে প্রায় ৭২৫ টাকা। প্রতি কেজি চিংড়ির দাম কমেছে ৪০০-৮০০ টাকা।

খালশিবুনিয়া গ্রামের মনোজ বৈরাগী গত ৫ বছর ধরে ৮৫ শতাংশ জমিতে চিংড়ি চাষ করেছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত জুনে ৮৫ শতক জমিতে ৮০ হাজার চিংড়ির পোনা ছেড়েছিলাম। ১৩৫ দিন পর বিক্রি করেছি ১৬ লাখ টাকায়। খরচ হয়েছিল ২২ লাখ টাকার বেশি।'

তিনি আরও বলেন, 'একটি এনজিও থেকে ৮ লাখ টাকা ধার নিয়েছিলাম। স্বজনদের কাছ থেকেও কিছু টাকা নিয়েছিলাম। কীভাবে এখন তা শোধ করব ভেবে পাচ্ছি না।'

শুধু বটিয়াঘাটার খালশিবুনিয়া গ্রামেই ২৫০ চিংড়ি ঘের আছে। এখানে প্রায় সব চাষিই লোকসানে পড়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের অধিকাংশই এনজিও বা সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে চিংড়ি চাষ করেছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য পবিত্র রায় ২ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত দুই বছরের তুলনায় দাম কিছুটা বেশি হওয়ায় লাভের স্বপ্ন দেখছিলাম। দাম কমে যাওয়ায় সংকটে আছি।'

'এমন সমস্যা হলে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাবে। এই শিল্প গভীর সংকটে পড়বে,' বলে মনে করেন তিনি।

সরেজমিনে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের কয়েকটি চিংড়ি ঘের ও বাজার ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতারা স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে চিংড়ি কিনতে ঘেরে যেতে রাজি হচ্ছেন না। জেলেরা জেলা শহরের বাজার ও হিমায়িত খাদ্য কোম্পানিতে চিংড়ি আনার চেষ্টা করছেন। অনেকে লোকসান কাটিয়ে উঠতে স্থানীয় বাজারে কম দামে চিংড়ি বিক্রি করছেন।

চিংড়ি চাষে বিপর্যয়
চিংড়ি বাছাই। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বড় ৫ ব্যবসায়ী এখন চিংড়ি কিনছেন না বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।

কয়রা উপজেলার দুটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, তারা ছোট-বড় আকারের চিংড়ি বাছাই করে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।

খুলনার কয়রার ব্যবসায়ী ইনসান আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশিরভাগ চিংড়ি ইউরোপে যায়। ২ মাস ধরে রপ্তানিকারকরা চিংড়ি পাঠাতে পারছেন না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। এ কারণে কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত দাম কমাচ্ছে। ২ মাস আগে যে চিংড়ি কেনা হয়েছিল ৯০০-৯৩০ টাকায়, সেগুলো এখন ৫২০-৬০০ টাকায় কিনছি। যেগুলো অন্তত ১ হাজার টাকায় কেনা হতো সেগুলো কিনছি ৬৫০ টাকায়।'

বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও আছিয়া সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরিকুল ইসলাম জহির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে অর্ডার পাচ্ছি না। ডলারের বিপরীতে ইউরো, পাউন্ডের দাম কম হওয়ায় তারা কিনছে না।'

'আমরা জেলি-পুশড চিংড়ির বিষয়ে খুব সতর্ক। কিছু অসাধু লোক এটা করে,' যোগ করেন তিনি।

ফকিরহাটের বেতাগা এলাকার চিংড়ি চাষি অতুল কাপালি ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি প্রায় ৯৫ শতাংশ জমির ৪ পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষ করেছেন।

তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে খুব কম দামে ১০ মণ গলদা চিংড়ি বিক্রি করেছি। গত বছর ২০-২২ চিংড়ির কেজি ১২০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন তা বিক্রি করছি মাত্র ৮০০-৯০০ টাকায়।'

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম সোহেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিংড়ির দাম কম থাকায় হাজার হাজার চাষি চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। করোনার পর তারা আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, এক বছর পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কম দামের কারণে তা পারছেন না।'

বাগেরহাটের মোংলা ও রামপাল উপজেলায় প্রধানত চিংড়ি চাষ হয়। ফকিরহাট, মোল্লাহাট, চিতলমারী, মোরেলগঞ্জসহ বাকি ৭ উপজেলা গলদা চিংড়ির জন্য বিখ্যাত।

খুলনার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চিংড়ির উৎপাদন বাড়াতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে নজর দিতে হবে, যাতে যেখানে চাষিরা ন্যায্য মূল্যে চিংড়ি বিক্রি করতে পারেন।'

চিংড়ির দাম কম হওয়ায় কৃষক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, বলেও জানান তিনি।

খুলনা জেলায় মোট ৩১ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে ৫৯ হাজার ৩২২টি ঘের আছে। গত অর্থবছরে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে ৩৩ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে।

খুলনা বিভাগের উপপরিচালক মো. তোফাজউদ্দিন আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মৌসুম ও বৈশ্বিক কারণে খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা সংকটে পড়েছেন। সাধারণত, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দাম কমে। ফেব্রুয়ারির পর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আবার দাম বাড়তি থাকবে।'

তিনি আরও বলেন, 'এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় উৎপাদনও কমেছে। এসপিএফের (নির্দিষ্ট প্যাথোজেনমুক্ত) অভাবে চাষিরা মানসম্পন্ন মাছ পান না। এ বছর থেকে ৩ হ্যাচারির পরিবর্তে ৮ হ্যাচারিতে ভালো পোনা উৎপাদন করে সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও গোপালগঞ্জে ৭ হাজার চিংড়ি চাষিকে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন প্রজেক্টের আওতায় প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাদের মধ্যে ৩ হাজার কৃষককে উপকরণ সহায়তা দিচ্ছি। তারা কিছুটা হলেও এর থেকে উপকার পাবেন।'

Comments