মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও খেলাপি ঋণ নিয়ে আইএমএফের উদ্বেগ

বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিদল জানতে চায়- বিশ্বের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে কেন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফ, ডলার,
রয়টার্স ফাইল ফটো

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্টাফ মিশন গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে করেছে। বৈঠকে তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব আয় এই চারটি বিষয় উত্থাপন করেছে।

বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতায় সরকারের অগ্রগতি এবং দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথ্য তুলে ধরা হয়।

বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিদল জানতে চায়- বিশ্বের অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির মাত্রা কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে কেন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারের নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চ মূল্যকে দায়ী করেন।

যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলতি বছরের জুলাইয়ে সরকার বাজারভিত্তিক সুদের হার চালু করে এবং পলিসি রেট বাড়িয়েছিল।

জবাবে আইএমএফ কর্মকর্তারা বলেন, অনেক দেশ আগেই তাদের সুদের হার বাড়িয়েছে এবং আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

কাকতালীয়ভাবে, আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি ‍সুদহার দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে।

আইএমএফ মিশন ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারিত ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক রিজার্ভ রাখার ব্যর্থতার কারণও জানতে চেয়েছিল। আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় ধাপের অনুমোদন পেতে এটি একটি বাধ্যতামূলক শর্ত ছিল।

জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, প্রয়োজনীয় আমদানির পাশাপাশি বাধ্যবাধকতা মেনে ঋণের অর্থ পরিশোধ করায় রিজার্ভ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারও আইএমএফ মিশনের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ ধরে রাখার ব্যর্থতার জন্য একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা তাদের জানিয়েছি, বাংলাদেশ সফলভাবে চলতি হিসাবের ব্যালেন্স ঘাটতি কমিয়েছে, কিন্তু আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি আছে, যা রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের সময়সীমা অনুযায়ী সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।

আইএমএফ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক উভয়েই ব্যাংকিং খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের সব সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে।

তবে, আইএমএফ বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের উচ্চ হার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

জুন শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা এই খাতের মোট ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ন্যূনতম ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা কর আদায়ে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এটি দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ অনুমোদনে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের জন্য নির্ধারিত ছয়টি শর্তের একটি

আইএমএফ মিশনের সঙ্গে আজ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৈঠকের কথা। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।

বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আগামী বছরের ডিসেম্বর ও জুনের জন্য দেওয়া কিছু শর্ত সংশোধনের প্রস্তাব দেন।

প্রস্তাবিত শর্তগুলোর একটি হলো ন্যূনতম নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ। শর্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কমপক্ষে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারে।

তাই রিজার্ভ নিয়ে আইএমএফের শর্ত পূরণ এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গতকাল বলেছেন, নিট রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি থাকতে পারে।

আইএমএফ মিশন এই সফরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে।

Comments