ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি: ট্রাম্পের ঘোষণা ও বাস্তবতা

গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালানোর পর শুরু হয় যুদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যেই গত রোববার ইরানের তিন পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল সোমবার রাতে কাতারের দোহায় মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান।
এরপরই যুদ্ধবিরতির কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আজ মঙ্গলবার ভোরে তিনি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কথা জানান।
বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লেখেন, যুদ্ধবিরতি 'এখন থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে' কার্যকর হবে।
তিনি আরও একটি সময়সীমা উল্লেখ করেন—প্রথম ছয় ঘণ্টা বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় শেষ হয়। এটি ছিল ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে 'ফাইনাল মিশন' শেষ করার সময়। ইরান প্রথমে যুদ্ধবিরতি শুরু করবে। ইসরায়েল ১২ ঘণ্টা পর যুদ্ধবিরতি অনুসরণ করবে।
এই সময়সীমার মধ্যে দিয়ে ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে '১২ দিনের যুদ্ধে'র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির কথা উল্লেখ করেন ট্রাম্প।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টা ৮ মিনিটে ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। অনুগ্রহ করে লঙ্ঘন করবেন না!'
ইসরায়েলকে ইরানে আর কোনো হামলা না চালানোর হুঁশিয়ারিও দেন ট্রাম্প।
এরপর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিও একইসময়ে জানায়, যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে।
যদিও পরে ইসরায়েল অভিযোগ করে যে, ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ইরান আবারও এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
তবে ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা সংস্থা হুঁশিয়ারি দেয় যে, ইসরায়েল আরও আগ্রাসী হলে কড়া জবাব দেওয়া হবে।
ট্রাম্পের পোস্টের এক ঘণ্টা পর ইসরায়েল জানায়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব মেনে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে।
ইরানও ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে তারাও একই পদক্ষেপ নেবে।
যুদ্ধবিরতি
ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প ইসরায়েলকে অনুরোধ করেন, 'ইরানে বোমা ফেলবেন না।'
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, হোয়াইট হাউজের বাইরে আজ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন যে, তিনি ইসরায়েলের ওপর খুশি না।
'উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি ভেঙেছে' উল্লেখ করে তিনি তাদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান।
ট্রাম্প বলেন, 'আমরা এখন এমন দুই দেশের কথা বলছি যারা এতদিন ধরে লড়ছে, এখন তারা নিজেরাও জানে না তারা কী করছে।'
ইরান-ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধবিরতির দুই ঘণ্টা পর ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স জানায়, তারা ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, ইরান চুক্তি সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করেছে এবং তিনি সেনাবাহিনীকে 'তেহরানে হামলা অব্যাহত রাখতে, অবকাঠামো ধ্বংস করতে' নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে, ইরানি সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদোলরহিম মোসাভি বলেন, ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়েনি।
ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েল যদি আবার হামলা চালায়, তাহলে 'সুনির্দিষ্ট, দৃঢ় ও সময়োপযোগী জবাব' দেওয়া হবে।
যুদ্ধবিরতির আগে দুই দেশের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা অব্যাহত ছিল।
আইডিএফ জানায়, সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত বেশ কয়েক দফা হামলা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা জানান, বিয়ারসেবা শহরে ৪ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হয়েছেন।
একইসময় ইরানি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, ইরান 'ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শেষ দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা' চালিয়েছে।
পরে তেহরান জানায়, যুদ্ধবিরতির আগে ইসরায়েলের হামলায় তাদের আরও এক পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন।
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির বাস্তবতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'যুদ্ধবিরতি' দাবি এখন আর কোনো অনন্য ঘটনা নয়, বরং এটা তার রাজনৈতিক কৌশলের নিয়মিত অংশ বলে আজ আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ মে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে- তার মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চারদিনব্যাপী ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার অবসান হয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্পের ওই যুদ্ধবিরতির দাবির বাস্তবতা ভেঙে পড়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঘণ্টাখানেক পরই দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
এরপর আবার গত ১৮ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বরাত দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বলেন, 'এটি (যুদ্ধবিরতি) দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার কারণে নয়।'
ট্রাম্প প্রশাসন গাজা যুদ্ধ বন্ধে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করে। গত ১৫ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং চার দিন পর তা কার্যকর হয়।
কিন্তু ১৮ মার্চ নেতানিয়াহু একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে গাজায় হামলা চালানোর নির্দেশ দেন এবং ট্রাম্প এ সিদ্ধান্তের প্রতি তার সমর্থনও জানান।
গতকাল সোমবারও গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৩ জন নিহত হয়েছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়েও ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পরপর যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সৌদি আরবে মার্কিন কর্মকর্তা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বহু আলোচনার পরও, তিন পক্ষই পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে পারেনি। এখনো পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
Comments