স্বাদে-ঘ্রাণে মন কাড়ে সিলেটের আখনি

সুগন্ধি চাল এবং মাংসযোগে আখনি রান্নার পদ্ধতি অনেকটা ঢাকার তেহারির মতো হলেও সুঘ্রাণ ও স্বাদের দিক দিয়ে এটি অনন্য।
সিলেটের আখনি
ছবি: স্টার

রমজানের ইফতার, ঈদের দুপুরের খাবার, ধর্মীয় আয়োজন কিংবা পারিবারিক উৎসব- সিলেটিদের পছন্দের তালিকায় সবার আগে যে সুস্বাদু খাবারটি থাকে, তা হচ্ছে আখনি।

সুগন্ধি চাল এবং মাংসযোগে আখনি রান্নার পদ্ধতি অনেকটা ঢাকার তেহারির মতো হলেও সুঘ্রাণ ও স্বাদের দিক দিয়ে আখনি অনন্য। সিলেটজুড়ে পাড়া-মহল্লার অজস্র রেস্টুরেন্টে রান্না হয় আখনি। এমনকি বড় হাঁড়িতে রান্না করা আখনির অনলাইনভিত্তিক একটি বাজারও সৃষ্টি হয়েছে সিলেটে।

পারস্য-দিল্লি হয়ে সিলেট

আখনি শব্দটির মূলত পারস্যের (বর্তমান ইরান) 'Yakhni (ইয়াখনি)' এর একটি রূপ। এ রান্নাটি পারস্য থেকেই পূর্বে ভারতবর্ষ ও পশ্চিমে তুরস্ক পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ইয়াখনি অর্থ হচ্ছে মাংসের স্টু বা ভাপে সেদ্ধ করা মাংস। ইয়াখনি পোলাও অর্থ স্টুতে রান্না করা চাল বা পোলাও।

আখনি
ছবি: স্টার

বাস্তবে আমাদের পরিচিত আখনি মাংসের ঝোলের মধ্যেই রান্না করা এক ধরনের পোলাও। সিলেটে এটি তাই আখনি পোলাও হিসেবেও পরিচিত। ভারতবর্ষে প্রথম 'ইয়াখনি' শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় মুঘল সম্রাট আকবরের 'আইন-ই-আকবর' গ্রন্থে। খাদ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পারস্যের এই খাবারটি মুঘল বাবুর্চিদের হাত ধরে এই অঞ্চলে এসে দিল্লি সালতানাতে জনপ্রিয়তা পায়।

সিলেটে আখনির আগমন ও জনপ্রিয়তার ব্যাপারে নথিভুক্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা যায়, দিল্লির জনপ্রিয় এই খাবার সিলেট অঞ্চলে দিল্লি থেকেই এসেছে।

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (র) দিল্লি হয়ে সিলেট গৌড় রাজ্যের রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করেন। দিল্লীর মসনদে তখন আলাউদ্দিন খিলজি। হযরত শাহজালাল (র) এর সিলেট বিজয়ের সময় তার সঙ্গে দিল্লী থেকে আসা খিলজি সৈনিকদের মাধ্যমেও এ অঞ্চলে আখনি বিস্তার লাভ করতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

আখনি রান্নার রেসিপি

আখনি রান্নার রেসিপি বাবুর্চিভেদে যেমন ভিন্ন ভিন্ন, তেমনি প্রতিটি পুরোনো বাড়িরই রয়েছে নিজস্ব রন্ধন পদ্ধতি।

প্রায় ৫০ বছরের অভিজ্ঞ বাবুর্চি জামাল মিয়া এবং ১৫ বছরের অভিজ্ঞ বাবুর্চি ইমন মিয়া আখনি রান্নায় প্রায় অভিন্ন এক পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

তারা জানান, আখনি রান্নায় বিরিয়ানির মতো বাসমতি চাল নয়, বরং ছোট দানার সুগন্ধি চিনিগুঁড়া কিংবা কালিজিরা চাল ব্যবহার করা হয়। চালের সমপরিমাণ গরু বা খাসি কিংবা মুরগির ছোট করে কাটা মাংস ব্যবহার করতে হয়। তবে মাংসের পরিমাণ অনেকে চালের তিন ভাগের দুই ভাগ কিংবা অর্ধেকও রাখেন। প্রথমে বড় একটি হাঁড়িতে সয়াবিন তেল কিংবা ঘি গরম করে তাতে কুচি করা পেঁয়াজ দেওয়া হয়। তারপর এতে সিলেটের জৈন্তাপুরের তেজপাতার সঙ্গে দারুচিনি, এলাচ ও লবঙ্গ দিয়ে কষানো হয়।

পেঁয়াজ ভাজা ভাজা হয়ে এলে আদা ও রসুন বাটার সঙ্গে টুকরো করে কাটা টমেটো দেওয়া হয়। এরপর পরিমিত লবণ দিয়ে চিনাবাদাম বাটা দেওয়া হয়। সব মসলা কষানো হয়ে গেলে এবার এতে মাংস ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর এতে জয়ত্রী ও জায়ফলের গুঁড়া দিয়ে বাড়তি আগুনে কষানো হয়। কষানোর মধ্যেই ধনে গুঁড়া, আস্ত জিরা, গুঁড়া জিরা, গুঁড়া পাঁচফোড়ন, আলু বোখারা দেওয়া হয়। আরও দেওয়া হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে আমের আচার। তারপর কিছুটা গরম পানি দিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে মাংস রান্না করতে হয়।

মাংস রান্না হয়ে এলে তাতে ছোট ছোট করে কেটে রাখা গাজর, আস্ত কিশমিশ, মটরশুঁটি ও কাঁচামরিচ দেওয়া হয়। সবকিছু ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে এলে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি দেওয়া হয়। এই পানি ফুটতে শুরু করলে আগে থেকে ধুয়ে রাখা চাল ঢেলে দিয়ে ভালো করে নেড়ে ভাত সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়।

ভাত প্রায় রান্না হয়ে এলে এতে পরিমিত ঘি ঢেলে দিয়ে হাঁড়ির মুখ ভালো করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় হাঁড়ির ঢাকনাতে জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে রাখা হয়। কিছুক্ষণ ভাপে রাখার পর ঢাকনা খুলে ভালো করে নেড়েচেড়ে দিলেই প্রস্তুত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আখনি।

বিরিয়ানি, তেহারি, আখনি—স্বাদের পার্থক্যই আসল

বিরিয়ানিতে মসলাদার মাংস এবং চাল আলাদা রান্না করা হয় এবং পরে ধাপে ধাপে রেখে ভাপ দিয়ে মেশানো হয়। কিন্তু আখনিতে সরাসরি মসলাদার মাংসের ঝোলেই চাল দিয়ে রান্না করা হয়। তাই আখনিতে মসলার স্বাদ-গন্ধই মুখ্য।

পাক্কি বিরিয়ানি নামে এক বিশেষ ধরনের বিরিয়ানি রান্না হয় ভারত এবং ঢাকায়। পাক্কি বিরিয়ানি মূলত একই হাঁড়িতে রান্না করা বিরিয়ানি। আখনিও মূলত এক ধরনের পাক্কি বিরিয়ানি। প্রথাগতভাবে বিরিয়ানি রান্নায় বেশি মসলা ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া মাংসের টুকরাও থাকে বড়, দেওয়া হয় আলুও। সেই তুলনায় তেহারিতে ও আখনিতে কম মসলা ও ছোট ছোট মাংসের টুকরা ব্যবহার করা হয়।

আবার তেহারির উৎপত্তি উত্তর ভারতের সুপ্রাচীন অযোধ্যাতে, অর্থাৎ এটি একটি আওয়াধি রেসিপি যা পরে ঢাকায় এসে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

তেহারি মূলত রান্না হয় সরিষার তেলে, যার ফলে সরিষার ঘ্রাণটাই এখানে প্রাধান্য পায়। কিন্তু আখনিতে সরিষার তেলের বদলে সাধারণ সয়াবিন তেল ও ঘি ব্যবহার করা হয়। ব্যাপক চাহিদার কারণে সিলেটের প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় আখনি। তাছাড়া বেশ কিছু বড় পরিসরের রেস্টুরেন্টও ভালো মানের আখনি পরিবেশন করে সুনাম কুড়িয়েছে। এ ছাড়াও ভালো আখনির চাহিদা থাকায় বেশ কিছু অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানও প্রতি শুক্রবার বড় হাঁড়িতে আখনি রান্না করে চাহিদা অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করছে।

ইফতার বাজারে আখনির চাহিদা

রমজান মাসে সিলেটের প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ইফতার সামগ্রীর মধ্যে আখনির উপস্থিতি থাকবেই। গরু ও মুরগি দুই রকম আখনিই ব্যাপক জনপ্রিয়।

দাড়িয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ আহমেদ জিন্দাবাজার এলাকার একটি রেস্টুরেন্ট থেকে গরুর মাংসের আখনি কিনছিলেন।

তিনি বলেন, 'রমজান মাসে ইফতারে বিশেষ আয়োজন মানেই আখনি লাগবে। যেহেতু বাসায় রান্না করা বেশ কষ্টসাধ্য, তাই ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে নেওয়াটাই সাশ্রয়ী।'

রেস্টুরেন্টে গরুর মাংসের আখনি কেজিপ্রতি ৩৮০ টাকা এবং মুরগির মাংসের আখনি ৩২০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে রেস্টুরেন্টভেদে দাম ১০ বা ২০ টাকা কম-বেশি হতে পারে।

সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাচ্চি বিরিয়ানি। ঢাকার বড় বড় ব্র্যান্ডের বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট সিলেটে আসছে। কালের পরিক্রমায় সিলেটি আখনির অনেক রেস্টুরেন্টও নাম পাল্টে বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এ খাবারের চাহিদা এখনও ব্যাপক। মাঝেমধ্যে কাচ্চি বিরিয়ানির রসনায় সিলেটিরা বিলাস করলেও নিত্যদিনের রসনা বিলাসে এখনও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আখনি।

 

Comments