ঢাকার নবাব ও তাদের রসনাবিলাসের খোঁজে

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন। ব্রিটিশ আমলে ঢাকার নবাবদের আবাসস্থল ছিল এই প্রাসাদটি। সেইসঙ্গে এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান, একইসঙ্গে ঐশ্বর্য আর আভিজাত্যের প্রতীকও। ভবনটি এখন জাদুঘর, এক সময়ের শক্তিশালী নবাব পরিবারের এই ঠিকানা দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে।
অনেক খাদ্যরসিকের মনেই প্রশ্ন জাগে, ঢাকার এক সময়ের এই অভিজাত পরিবারের সদস্যরা কেমন ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করতেন? কিংবা রোজকার খাবার টেবিলে কোন কোন খাবারই বা থাকত?
খাবারের বিষয়ে কথা বলার আগে প্রেক্ষাপট নির্ধারণের জন্য মৌলিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন। আর সেটি শুরু করার ভালো উপায় হলো, একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। প্রশ্নটি হলো, `বর্তমান ঢাকার মানুষ নবাবদের কীভাবে স্মরণ করে?'
কেউ কেউ বলেন, আহসান মঞ্জিলের বাসিন্দারা ছিলেন স্থানীয় জমিদার, যারা বিশাল এই প্রাসাদটিতে বসবাস করতেন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। আবার অনেকে বলেন, এই পরিবারের সদস্যরা বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। আবার অনেকেই ঢাকার উন্নয়নে এই পরিবারটির দারুণ অবদানের কথাও স্মরণ করেন।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, পরিবারটির জনহিতকর কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল মানুষের জন্য দান, পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষা ইত্যাদির উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা।
সেখান থেকে আরও জানা যায়, ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সরকার খাজা আব্দুল গণিকে (১৮১৩-১৮৯৬) নবাব উপাধি দেয়। খাজা আব্দুল গণিই তার ছেলে খাজা আহসানউল্লাহর (১৮৪৬-১৯০১) নামে তৈরি করেছিলেন আহসান মঞ্জিল। পরবর্তী সময়ে বাড়ির মালিক হন নবাব আহসানউল্লাহর ছেলে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫), যিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তী রাজনীতিবিদও।
আহসান মঞ্জিলের খাবার
আহসান মঞ্জিলের বাইরের দেয়ালের রং গোলাপি হওয়ায় এটি গোলাপি প্রাসাদ নামেও পরিচিদ। ভবনটি অত্যন্ত রাজকীয়, এর মনোরম সিঁড়ি, প্রশস্ত বারান্দা, অর্ধবৃত্তাকার খিলাম এবং মুকুটের মতো দেখতে চমৎকার গম্বুজ একে করেছে অনন্য।
কেবল বাইরের নির্মাণশৈলীই নয়, ভবনের ভেতরের জাঁকজমকপূর্ণ শৈলীও দারুণ নজরকাড়া। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আহসান মঞ্জিলের খাবার ঘর বা ডাইনিং হলের কথা।
দর্শনার্থীরা এই খাবার ঘরে প্রবেশ করে লম্বা আর আভিজাত্যপূর্ণ ডাইনিং টেবিল দেখে হতবাক হয়ে যান। টেবিলটি সাজানো থাকে সুন্দর সব তৈজসপত্র দিয়ে। অতীতে এই ডাইনিং হল কীভাবে নবাবরা খাবার খেতেন, সেসময়ের চামচ আর প্লেটের ঝনঝন শব্দ আর জমজমাট অবস্থার কথা চিন্তা করলেও অবাক লাগে।
বিষয়টি আরও ভালোভাবে জানতে আমরা কথা বলি লেখক-গবেষক ঢাকা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাদ উর রহমানের সঙ্গে। যিনি এই শহরের খাবার, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি না যে, এই ডাইনিং হলে কেবল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খাওয়ার খুব বেশি সুযোগ ছিল। কারণ বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে কর্মকর্তারা এবং আত্মীস্বজনরা বিভিন্ন কাজে সবসময়ই আহসান মঞ্জিলে যেতেন। যাদের বৈঠক বা আলোচনা শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব থাকত। তাই এই টেবিল কখনোই খালি থাকত না।'
অন্যদিকে পরিবারটির বংশধর এবং বাংলাদেশের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ইয়াসমিন মোর্শেদ তার 'খানা পিনা: মেমোরিজ অব ফুড অ্যান্ড ফ্যামিলি' বইয়ে লিখেছেন, 'ডাইনিং রুমটি ছিল পরিবারের সদস্যদের মধ্যাহ্নভোজ ও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক নৈশভোজের মিলনস্থল, যেখানে তারা পূর্ণদ্যোম নিয়ে উপস্থিত হতেন। লম্বা খাবার টেবিলটি নানা ধরনের সুগন্ধি খাবারে পরিপূর্ণ থাকত, সেগুলো উপস্থিত সদস্যদের এমনভাবে প্রলুব্ধ করত যে, থালা সামনে নিয়ে কারো পক্ষেই খুব বেশি অপেক্ষা করা সম্ভব হতো না।'
খাবারের তালিকা
নবাবদের রন্ধনপ্রণালী ছিল দারুণ বৈচিত্র্যময়। ইয়াসমিন মোর্শেদ লিখেছেন, 'খাবারের তালিকা বছরের দিনগুলোর মতোই দীর্ঘ ছিল। কারণ বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার পছন্দ করতেন পরিবারের সদস্যরা। খাবারের রুচি ফেরাতে ব্যস্ত থাকতেন রাঁধুনিরা, যাদের কাজের তদারকি করতেন নবাব পরিবারের বেগমরা।'
নবাব পরিবারটি কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাবারে সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলন দেখা যায়। যার উদাহরণও দিয়েছেন সাদ উর রহমান।
তিনি বলেন, 'আহসান মঞ্জিলে সাধারণত কাশ্মীরি চা পরিবেশন করা হতো, যা এই শহরের মানুষের জন্য সেসময় বেশ অপরিচিত ছিল। এমনকি এখনও এর খুব প্রচলন দেখা যায় না। এই চা দুই ধরনের ছিল, একটি হলো নামকিন চা বা নোনতা চা, অন্যটি শীর চা বা মিষ্টি চা।'
আরেকটি বিশেষ ধরনের পানীয় এই পরিবারে পরিবেশিত হতো, যার নাম নমশ বা নিমাশ। ইয়াসমিন মোর্শেদের বর্ণনা অনুযায়ী, এটি শীতকালে পরিবেশিত হতো, যা ছিল মূলত লম্বা গ্লাসে পরিবেশিত হুইপড ক্রিম।
এটি তৈরির জন্য মিষ্টি দুধকে সারারাত ঠান্ডায় রেখে দেওয়া হতো। পরদিন সকালে একটি চাকার মতো যন্ত্র দিয়ে দুধটি ফেটানো হতো। আর এভাবেই তৈরি হতো ক্রিমজাতীয় এই পানীয়, যা লম্বা গ্লাসে ঢেলে পরিবেশন করা হতো।
আরেকটি বিশেষ খাবার ছিল খোশকা। সাদ উর রহমান বলেন, 'এটি মূলত খাসির মাথা ও মাংস দিয়ে তৈরি হতো, যা রান্না করা হতো দুধ ও ঘি দিয়ে। সাধারণত সাদা ভাতের সঙ্গে এটি পরিবেশন করা হতো।"
শুনেই মনে হচ্ছে রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার।
সাদ আরও বলেন, 'নবাব পরিবারের খুব পরিচিত খাবার ছিল কাবলি পোলাও, যা খুব জনপ্রিয়ও ছিল। তবে আমরা যে কাবলি পোলাও চিনি, তার সঙ্গে একে মেলাবেন না। নবাবদের কাবলি পোলাও ছিল ভিন্ন ধরনের, এতে কিশমিশ, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, ডালিম ফল, জাফরান এবং ঘির মতো উপাদান ব্যবহার করা হতো, যা তৈরি করা ছিল ভীষণ ব্যয়বহুল।'
এসব খাবার যদি খুব রহস্যময় মনে হয় তাহলে নবাব পরিবারের আরও কিছু খাবারের কথা বলি যেগুলোর সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত। 'ঢাকাই রন্ধনশৈলী' বইতে সাদ নবাবদের প্রিয় এবং পছন্দের বেশকিছু সুস্বাদু ইফতারের কথা উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে কাবাব, বিরিয়ানি, দই বড়া এবং ফালুদা। হয়তো নবাবদের হেঁশেলের স্বাদ বা রেসিপি সবই আলাদা ছিল, তবু এখন খাবারগুলো আমাদের কাছে পরিচিত।
কাশ্মীরের প্রভাব ছাড়াও নবাবদের খাদ্যাভ্যাস মোগল, ব্রিটিশ এবং বাংলার আঞ্চলিক স্বাদ দিয়েও প্রভাবিত ছিল। প্রায়ই নবাবদের নিজস্ব পছন্দ এবং ইচ্ছা অনুযায়ী খাবার রান্না করা হতো। উদাহরণ হিসেবে, ইয়াসমিন মোর্শেদ তার বইয়ে বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশ সম্পর্কে লিখেছেন, 'নবাব পরিবারের জন্য সাধারণত ইলিশ রান্না করা হতো দই দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হতো চিনি ও তেঁতুল, যা মাছটিতে ভিন্ন ধরনের টক-মিষ্টি স্বাদ নিয়ে আসত।'
আহসান মঞ্জিল ঘুরতে গেলে আমাদের মনে পড়ে যায়, এই পরিবারটির ঢাকার মানুষের জন্য করা বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর কাজের কথা, বাংলার রাজনীতিতে এই পরিবারটির অবদানের কথা।
সেই সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখা উচিত যে, রসনাবিলাস রাজনীতির মতোই জটিল বিষয়। আর আহসান মঞ্জিল এ দুই ক্ষেত্রেই ছিল অনন্য।
এই লেখায় গবেষণায় সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ফোরাম ফর হেরিটেজ স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াকার এ খানকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাই।
প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে স্টার লাইফস্টাইল এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মধ্যকার সহযোগিতার অংশ হিসেবে।
ছবি: অর্কিড চাকমা
অনুবাদ: শেখ সিরাজুম রশীদ
Comments