কোলাজেন কেন প্রয়োজন, কাদের ঝুঁকি বেশি?

বর্তমানে ত্বক, চুল, নখ ও জয়েন্টের সুস্থতার জন্য কোলাজেন একটি বহুল আলোচিত উপাদান। আলোচিত উপাদান হলেও কোলাজেন নামক এই উপাদান সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই অনেকেরই। জানা নেই কোন ধরনের খাদ্য থেকে কোলাজেন পাওয়া যায়।
চলুন জেনে নিই শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান কোলাজেন সম্পর্কে কিছু তথ্য। এ বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন এমএইচ সমরিতা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পুষ্টিবিদ আঞ্জুমান আরা শিমুল।
আঞ্জুমান আরা শিমুল বলেন, কোলাজেন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি আমাদের শরীরের অন্যতম প্রধান কাঠামোগত প্রোটিন। এই কাঠামোগত প্রোটিনের অভাবে শরীরের স্বাভাবিক গঠন ও বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ কোলাজেন আমাদের শরীরের ত্বক, হাড়, কার্টিলেজ, টেন্ডন, লিগামেন্ট, দাঁত, রক্তনালী ও বিভিন্ন টিস্যুর মূল গঠন উপাদান হিসেবে কাজ করে। একে অনেকেই শরীরের 'আঠা' বা গ্লু বলে। কারণ এটি টিস্যুগুলোকে একসঙ্গে ধরে রাখে এবং মজবুত করে।
গঠন
কোলাজেন মূলত তিনটি অ্যামিনো অ্যাসিড—গ্লাইসিন, প্রোলিন ও হাইড্রক্সি-প্রোলিন দিয়ে গঠিত, যা একটি 'ট্রিপল হেলিক্স' স্ট্রাকচার তৈরি করে। মানুষের শরীরের মোট প্রোটিনের প্রায় ২৫–৩৫ শতাংশ হলো কোলাজেন।
প্রধান ধরন
মানুষের শরীরে অন্তত ২৮ ধরনের কোলাজেন আছে। কিন্তু এর মধ্যে ৫টি টাইপ গুরুত্বপূর্ণ।
টাইপ I ত্বক, হাড়, টেন্ডন, দাঁতে শক্তি ও কাঠামো প্রদান
টাইপ II কার্টিলেজ, চোখের ভিট্রিয়াসে জয়েন্ট ও কার্টিলেজ সাপোর্ট
টাইপ III ত্বক, রক্তনালী, অভ্যন্তরীণ অঙ্গের নমনীয়তা প্রদান
টাইপ IV বেসমেন্ট মেমব্রেন সেল ফিল্টারেশন ও টিস্যু বাউন্ডারি
টাইপ V চুল, প্লাসেন্টা, চোখের কর্নিয়া সূক্ষ্ম টিস্যু গঠন
কাজ ও গুরুত্ব
- কোলাজেন ত্বকের ইলাস্টিসিটি, দৃঢ়তা ও আর্দ্রতা ধরে রাখায় কাজ করে।
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস রোগ কার্টিলেজ ক্ষয় কমাতে ও ব্যথা উপশমে সাহায্য করে।
- অস্টিওপোরেসিসে হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের সঙ্গে।
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কিছু ক্ষেত্রে ইনফ্লেমেশন কমাতে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখে।
- টেন্ডন ও লিগামেন্টের ক্ষতিপূরণে ভূমিকা রাখে।
- কোলাজেন ক্ষত সারিয়ে নতুন টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে।
- বয়সজনিত পেশী ক্ষয় (বিশেষত ৫০+) কোলাজেন পেপটাইড + রেজিস্ট্যান্স এক্সারসাইজে ভালো ফল মেলে।
- কোলাজেনের গ্লাইসিন ও গ্লুটামিন অন্ত্রের দেয়াল রিপেয়ারে সাহায্য করতে পারে। মিউকোসাল হিলিংয়ে সাহায্য করে।
- মাড়ি ও দাঁতের চারপাশের টিস্যু শক্ত করতে সাহায্য করে। ডেন্টাল সার্জারির পর হাড় ও গাম রিপেয়ারে।
- মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন কমে যাওয়ায় কোলাজেন ক্ষয় হয়, ফলে হাড় ও ত্বক দ্রুত দুর্বল হয়।
কোলাজেন আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদিত হয়। কিন্তু বয়স, অপুষ্টি, অতিরিক্ত সূর্যালোক, ধূমপান, মানসিক চাপ ও অসুস্থ জীবনযাপনের কারণে এর উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যায়। ২৫ বছর বয়সের পর থেকে কোলাজেন উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। মেনোপজের পর নারীদের কোলাজেন ক্ষয় প্রতি বছর প্রায় ২ শতাংশ হারে বাড়ে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, ধূমপান, প্রোটিন ঘাটতি, ভিটামিন 'সি'র অভাব এসব কোলাজেন নষ্ট করে। কোলাজেনের এই ঘাটতি পূরণের জন্য কোলাজেন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন।
কোলাজেন সরাসরি কিছু প্রাণীভিত্তিক খাবারে পাওয়া যায়, আর কিছু খাবার শরীরে কোলাজেন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড ও ভিটামিন সরবরাহ করে।
১. কোলাজেন-সমৃদ্ধ খাবার (সরাসরি কোলাজেনের উৎস) অর্থাৎ আগে থেকেই কোলাজেন থাকে, খেলে শরীরে সরাসরি শোষিত বা অ্যামিনো অ্যাসিডে ভেঙে কোলাজেন তৈরি হয়। তবে কোলাজেন শোষণের জন্য সহায়ক উপাদানের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি।
- গরুর চামড়া, হাড় ও তরুণাস্থি টাইপ I ও টাইপ III কোলাজেনে সমৃদ্ধ
- মাছের চামড়া, আঁশ, হাড়ে যেমন: স্যালমোনা ও টুনা মাছে টাইপ I কোলাজেন বেশি থাকে।
- মুরগির তরুণাস্থি ও হাড়ে পাওয়া যায় টাইপ II কোলাজেন।
- জেলাটিনে (প্রাণী হাড় বা চামড়া থেকে তৈরি) টাইপ I কোলাজেন থাকে। ডেজার্টে ব্যবহার করা যায়।
২. কোলাজেন-বুস্টিং খাবার
কিছু খাবার আছে যেগুলোতে কোলাজেন না থাকলেও সেগুলো কোলাজেন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান দেয়।
ভিটামিন সি: কমলা, লেবু, আঙুর, কিউই, ক্যাপসিকাম, টমেটো কোলাজেন সিন্থেসিসে অপরিহার্য।
প্রোলিন: ডিমের সাদা অংশ, বাঁধাকপি, মাশরুম, অ্যাসপারাগাস কোলাজেনের প্রধান অ্যামিনো অ্যাসিডের উৎস।
গ্লাইসিন: মুরগি, মাছ, জেলাটিন, কুমড়ার বীজ কোলাজেনের বেসিক বিল্ডিং ব্লক।
কপার: কাজু বাদাম, তিল, ডার্ক চকলেট কোলাজেন ক্রস-লিঙ্কিং শক্ত করে।
জিঙ্ক: কুমড়ার বীজ, কাজুবাদাম, ডাল কোলাজেন রিপেয়ারে সহায়ক।
ওমেগা-৩: স্যামন, সার্ডিন, ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড ইনফ্লেমেশন কমিয়ে কোলাজেন রক্ষা করে।
টিপস
- প্রতিদিন বোন ব্রথ, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল ও প্রোটিন খেলে কোলাজেন সিন্থেসিস ভালো হয়।
- যারা প্রাণীজ উৎস কম খান, তারা সয়াবিন, ডাল, বাদাম ও বীজ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে কোলাজেন তৈরি বাড়াতে পারেন।
- রান্নার সময় হাড় ও স্নায়ুসহ মাংস ব্যবহার করলে প্রাকৃতিক কোলাজেন পাওয়া যায়।
কোলাজেন প্রোটিন অনেক রোগীর জন্য উপকারী হলেও কিছু নির্দিষ্ট অবস্থায় এটি সমস্যা বা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কোলাজেন আসলে প্রাণী উৎস থেকে তৈরি (গরু, মাছ, মুরগি) হওয়ায় এতে অ্যামিনো অ্যাসিড (বিশেষত গ্লাইসিন, প্রোলিন, হাইড্রক্সি-প্রোলিন) প্রচুর থাকে।
যেসব রোগীর জন্য কোলাজেন প্রোটিন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে
১. কিডনি রোগী (সিকেডি বা ডায়ালাইসিস রোগী): কোলাজেনে প্রোটিন ঘনমাত্রায় থাকে, যা ইউরিয়া ও ক্রিটেনিন বাড়িয়ে দিতে পারে।
২. হাই ইউরিক অ্যাসিড বা গাউট রোগী: কোলাজেনে পিউরিন তুলনামূলক কম, কিন্তু প্রাণী উৎস হওয়ায় ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন বাড়াতে পারে।
৩. গুরুতর লিভার রোগী: লিভার প্রোটিন মেটাবলিজম ঠিকমতো করতে না পারলে অ্যামোনিয়া লেভেল বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে মানসিক বিভ্রান্তি বা ঘুম ভাব হতে পারে।
৪. হজমের সমস্যা বা ইরিটেবল বাওয়েল (আইবিএস): কোলাজেন পাউডার কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অ্যাসিডিটি, গ্যাস, ডায়রিয়া বা পেট ফাঁপা বাড়িয়ে দিতে পারে।
খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন সি, জিঙ্ক, কপার ইত্যাদি থাকে। তবে শরীর নিজেই প্রয়োজনীয় কোলাজেন তৈরি করতে সক্ষম। তবে বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে বরং শরীরের ক্ষতি হয়। সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
Comments