আমিই রামনাথ

রামনাথের জীবনিকার শ্যামসুন্দর বসু ও তার লেখা ২ বই। ছবি: সংগৃহীত

রামনাথ বিশ্বাস ছিলেন অসম সাহসী ভূ-পর্যটক, বিপ্লবী ও মানবদরদি। পৃথিবী ঘুরে দেখার বাসনা তার মনে টগবগিয়ে ফুটতো। শত প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা জয় করে নিজের ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন কালজয়ী বিশ্বপর্যটক।

রামনাথের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে। যদিও বানিয়াচংকেই নিজের দুনিয়া বলতেন তিনি, কিন্তু ঘরকুনো বাঙালি হয়ে থাকেননি কখনোই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়ে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যান তিনি। ১৯২৪ সালে পল্টন ছেড়ে মালয়ে উপদ্বীপে কাজ নেন। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে বিশ্ব পরিক্রমা শুরু করেন বাইসাইকেলে। তখন তার বয়স ৩৫ বছর।

বিত্ত-বৈভব তার ছিল না বললেই চলে। কিছু টাকা-কড়ি যোগাড় হলেই বেরিয়ে পড়েছেন অজানার টানে। ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, সাইকেলে প্যাডেল চেপেই ৪টি মহাদেশ ঘুরে দেখেছেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক শঙ্কু মহারাজের ৫০টিরও অধিক ভ্রমণ বিষয়ক বই রয়েছে। তারপরই ভ্রমণ বিষয়ক সর্বাধিক বই লিখেছেন রামনাথ বিশ্বাস। তার ভ্রমণ গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টি।

এ ছাড়া, গল্প ও উপন্যাসও লিখেছেন রামনাথ বিশ্বাস। ভ্রমণ লেখা শেষ করার পর প্রকাশকের অভাবে একসময় নিজেই প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। নিজের প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করেন।

২ চাকায় পৃথিবী তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সুজলা-সুফলা বাংলাকে চেতনায় নিয়ে। এটাই তার সবচেয়ে বড় অহংকার। তার প্রতিটি কথা, কাজ ও চিন্তায় ঝলসে ওঠা তেজস্বী মানুষের ছাপ পাওয়া যায়। সবসময়ই মাথা উঁচু করে আত্মপরিচয় দিতেন। তিনি বলতেন, 'আমি বাঙালি প্রথম। বাঙলা ভাষা যারা বলে তারাই আমার ভাই। তারপর ইন্ডিয়ান।'

তার গানের ছন্দে যে পঙক্তি নাচানাচি করত তা হলো, 'বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি, আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।'

নাম জাহির করলে পর্যটন হয় না, হয় আরাম ও বিরাম। কি অবলীলায় তিনি এমন ভবিষৎবাণী করেছিলেন, তা টের পাওয়া যায় হাল জমানার ফেসবুক ও মিডিয়া ভ্রমণ সেলিব্রেটিদের দেখলে। নিজে কয়টি দেশ ঘুরলেন, পতাকা নিয়ে কি করলেন তারই আস্ফালন। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তাই তো আগেই বলেছেন, 'আকাশে পাখি নেই/ মশারাই আজ খ্যাতির শীর্ষে।'

লাখো সাইক্লিস্ট রয়েছেন দেশে, সংগঠনেরও অভাব নেই। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণ বই বা বাংলা ভাষার ভ্রমণ বই নিয়ে তারা সবসময়ই অনাগ্রহী। নিজের নাম ও খ্যাতির পেছনে ছুটছেন। অগ্রপথিকদের শ্রদ্ধা জানানোর সময় কোথায়! তারা ভুলে যান, যে জাতি জ্ঞানী-গুণীদের সম্মান দেয় না, সেখানে জ্ঞানী ও গুণী জন্মও নেয় না।

বাংলা ভাষায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ (শুধু বাংলাদেশি লেখক) ভ্রমণ বিষয়ক বই রয়েছে। কেবল সেজান মাহমুদ ১৯৯২/৯৩ সালে 'বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ অভিযাত্রী' বইতে রামনাথ বিশ্বাসের কথা লিখেছেন। পরবর্তীতে এই লেখকের সঙ্গে যখন শ্যামসুন্দর বসুর দেখা হয়, তিনি লেখককে 'রামনাথের পৃথিবী' বইটি উপহার দেন। শ্যামসুন্দর বসু ১২ বছর গবেষণা করে 'রামনাথের পৃথিবী' বইটি লিখেছেন। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ শ্যামসুন্দর বসুর প্রতি। আমাদের কৃতজ্ঞতা নিত্য উপহারের প্রতিও। আমার অনুরোধে বাহার রহমান ভাই রামনাথ বিশ্বাসের ওপর ২টি টিশার্ট করেছেন।

আমরা জানি, কলকাতায় রামনাথ বিশ্বাসের নামে রয়েছে রামনাথ বিশ্বাস লেন। মুম্বাইতে রামনাথের নামে পুরস্কার দেওয়া হয়। অথচ নিজ দেশেই তার পিতৃভিটা বেদখল হয়ে আছে। সাংবাদিক রাজিব নূরসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিক রামনাথের বসতভিটায় গিয়ে দখলদারদের মারধরের শিকার হয়েছেন। এটা অন্যায়। এটা মেনে নেওয়া যায় না। শুধু রামনাথ বিশ্বাসই নয়, দেশে কত শত মানুষের ভূমি বেদখল হয়ে আছে, তার হিসাব কি আমরা রাখি? আমরা যদি এর প্রতিবাদ করি, তবেই তো আমাদের জন্ম সার্থক হবে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর চেয়ে বছর দশেকের বড় ছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। কিন্তু সৈয়দ সাহেবের লেখায় কখনো রামনাথ বিশ্বাসের কথা এসেছে কি না জানা নেই। আমার জানা মতে, সৈয়দ মুজতবা আলীর ওপর ৪ জন পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। একজন বাংলাদেশের, বাকি ৩ জন পশ্চিমবঙ্গের। তার ওপর আরও অনেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের চেষ্টা করছেন। তবে রামনাথ বিশ্বাসের ওপর এখন অবধি কেউ পিএইচডি করেননি। তাকে নিয়ে পিএইচডি বা গবেষণা করতে কেউ কি এগিয়ে আসবেন না? বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন ভ্রমণের ওপর ২টি পদক দেবে ২০২২-২০২৩ সালে। যার একটি সৈয়দ মুজতবা আলীর নামে এবং অপরটি রামনাথ বিশ্বাসের নামে।

আমরা বিদেশ ভ্রমণে গেলে সে দেশের বিখ্যাত মানুষের বাড়ি, জাদুঘর পরিদর্শন করি। আমাদের দেশেও অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন। তাদের অন্যতম হলেন— এফ আর খান, ব্রজেন দাস, অতীশ দীপঙ্কর, রামনাথ বিশ্বাস, সৈয়দ মুজতবা আলী, শ্রী চিন্ময়, আবেদ খান। এই তালিকা আরও অনেক লম্বা হবে। তাদের নামে আমাদের কি কিছুই করণীয় নেই? আমাদের দেশে এতো পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল— আমরা কি তাদের জন্মদিনে, মৃত্যু দিবসে প্রচারের দায়িত্ব নিতে পারি না?

২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। এমন একটি সুন্দর দিনে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি বাইসাইকেল শোভাযাত্রা আয়োজন করেছে। ওই দিন সকাল ১১টায় হবিগঞ্জের টাউন হল থেকে শুরু হয়ে বানিয়াচং অবধি যাবে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন দেশের বিভিন্ন সাইক্লিং সংগঠন, সাইক্লিস্ট, সাহিত্যিক, সমাজসেবক, সাংবাদিক তথা রামনাথ বিশ্বাসের ভক্তকুল।

আপনিও আসুন। বিশ্বপর্যটক, লেখক ও বিপ্লবী রামনাথ বিশ্বাসের 'পৃথিবী' পুনরুদ্ধার করি। সেখানে ভ্রমণ বিষয়ক বইয়ের একটি বিশেষায়িত পাঠাগার ও বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়ায় অংশ নেই। রামনাথকে ফিরিয়ে দেই তার 'দুইন্যাই'।

রামনাথকে নিয়ে আরও কিছু কাজ চাইলেই করা যায়। ঢাকায় সম্প্রতি সাইকেল লেন চালু হয়েছে। সেটির নামকরণ রামনাথ বিশ্বাসের নামে হতেই পারে। রামনাথ বিশ্বাসের জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সাইক্লিস্ট সংগঠনগুলো আয়োজন করতে পারে জনসচেতনামূলক সাইক্লিং র‌্যালি।

বাংলাদেশ থেকে ৩টি বড় কোম্পানি সাইকেল রপ্তানি করে থাকে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৮ম বৃহত্তম সাইকেল রপ্তানিকারক দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৃতীয় বৃহত্তম সাইকেল যোগানদাতা। আমরা সাইকেল চালিয়ে বিশ্ব ঘুরে দেখা রামনাথ বিশ্বাসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতেই পারি।

আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল: ভূ-পর্যটক; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

6h ago