গ্রামবাসীর বিজয় উৎসব

বৈঠকখানা সেজেছে উৎসবের সাজে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

উঠানের মাঝে পোঁতা হয়েছে বাঁশ। তাতে উড়ছে জাতীয় পতাকা। বাঁশকে কেন্দ্র করে উঠানের চারপাশ সাজানো হয়েছে কাগজের জাতীয় পতাকা ও রঙিন কাগজে।  বৈঠকখানা নামে পরিচিত এই উঠানে সচরাচর গ্রামের সালিশ, আচার-বিচার অনুষ্ঠিত হলেও এই দিনটিতে পুরোই ব্যতিক্রম।

উৎসবের আবহ গ্রামের ঘরে ঘরে। বিগত কয়েক দিনে সামর্থ্য অনুযায়ী তোলা হয়েছে চাঁদা। সেই চাঁদার টাকাতেই চলেছে এই আয়োজন। সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব চলেছে রাত ৯টা পর্যন্ত।  

বলছিলাম ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার শাক্তা ইউনিয়নের করিম হাজীর গ্রামের কথা। রাজধানীর অদূরে এই গ্রামের মানুষ প্রতি বছর বিজয় দিবস উদযাপন করেন এভাবেই। সেই উৎসবে মিশে থাকে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের বার্তা।

গতকাল বিজয় দিবসে সেই গ্রামে গিয়ে দেখা মিলল তেমনই এক আয়োজনের। উৎসবে শামিল হয়েছেন গ্রামের ছেলে-বুড়ো, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সবাই।

আগের রাতেই বৈঠকখানার উৎসবের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন গ্রামবাসী। গ্রামের ছেলেরাই বৈঠকখানার মাঝে বাঁশ পুঁতে রশি টাঙিয়ে রঙিন জাতীয় পতাকায় সাজিয়ে তোলেন গোটা উঠান। আর মেয়েদের দায়িত্বে ছিল খাবারের দেখভাল। সকালে জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের আয়োজন।

প্রথমেই শিশুদের জন্য ছিল চকলেট দৌড় প্রতিযোগিতা। উঠানের একপ্রান্তে দড়িতে চকলেট ঝুলিয়ে অপর প্রান্তে শিশুদের হাত বেঁধে দেয়া হয়। যে আগে দৌড়ে চকলেট মুখে পুরে উঠানের প্রান্তে আবার ফিরে আসতে পারবে সেই হবে বিজয়ী। উঠানের পাশেই গ্রামবাসীর জমায়েত, তারাই দর্শক। দৌড় শুরু হতেই হৈ-হৈ রবে আনন্দে ফেটে পড়ে গ্রামবাসী।

সব বয়সীদের মিলনমেলা। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

এরপর শুরু হয় শিশুদের মার্বেল খেলা, তারপর যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা। সেখানে শিশুরা কেউ সাজে বঙ্গবন্ধু, কেউ সাজে মুক্তিযোদ্ধা। এরপর শিশুদের মোরগ লড়াই ও দড়ি খেলা চলে। সবশেষে শুরু হয় পুকুর পাড় খেলা। শিশুরা একটি বড় বৃত্তের বাইরে থেকে লাফ দিয়ে বৃত্তের ভিতরে প্রবেশ করে এবং আরেক লাফে বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসে। শর্ত হলো, যে দাগ স্পর্শ করবে কিংবা ২ পায়ের বদলে এক পা ফেলবে সেই বাদ পড়বে। মজার ছলে আয়োজিত এই খেলায় উত্তেজনা জমে যায় গ্রামবাসীদের মাঝে। সবাই প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে কে হবে বিজয়ী। বিজয়ী পেয়ে যেতেই দুপুর ১টায় ইতি নামে উৎসবের প্রথম পর্বের।   

উৎসবের এক পর্যায়ে করিম হাজী গ্রামের বাসিন্দা শারমিন বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বছরের এই একটা দিনই গ্রামের মানুষ সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে। ফলে সবার মাঝেই একটা সম্প্রীতি গড়ে উঠে। আগে আরও বড় পরিসরে আয়োজন হলেও বর্তমানে অর্থের অভাবে তেমন বড় অনুষ্ঠান করা যায় না। কিন্তু সবাই যে আমরা একসঙ্গে বছরের একটি দিন আনন্দ করতে পারছি, এটাই তো বড় বিষয়। শিশুরাও এই দিনটির জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে।' 

দুপুরের মধ্যাহ্নভোজনের পর শুরু হয় গ্রামের উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব। যেখানে হাজির হয় গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা। সকালের মতো চলে নানা খেলার আয়োজন। কিশোরদের জন্য বাড়তি ছিল বালিশ খেলা। এরপরই শুরু হয় দড়ি লাফ। গ্রামবাসীর মাঝে বয়ে যায় আনন্দের জোয়ার। কেউ সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেন, কেউবা উচ্চস্বরে দিয়ে যান উৎসাহ।

শেষ বিকেল নাগাদ শেষ হয় কিশোরদের আয়োজনও।

রঙিন কাগজ আর কাগজের পতাকায় সাজ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

সন্ধ্যা নামতেই জ্বলে উঠে বৈঠকখানার চারকোণে লাগানো আলো। সেই আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে বৈঠকখানার সম্মুখভাগ। পরবর্তী আয়োজন তরুণ ও অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের জন্য হাঁড়ি ভাঙা প্রতিযোগিতা। প্রথমে তরুণদের দিয়ে শুরু হয় হাঁড়ি ভাঙা প্রতিযোগিতা। গ্রামের সব পরিবার থেকেই কমপক্ষে একজন করে প্রতিনিধি অংশ নেন এ প্রতিযোগিতায়। তরুণরা ব্যর্থ হলে শুরু হয় বয়োজ্যেষ্ঠদের হাঁড়ি ভাঙা। সেখানেও হাঁড়ি ভাঙতে ব্যর্থ হন সবাই। লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাতের স্থান থেকে হাঁড়ির দূরত্ব পর্যন্ত মেপে পরে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

প্রতিযোগিতার এক ফাঁকে করিম হাজী গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ মিলন বলেন, 'গ্রামবাসীর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রাখার জন্য গত ২০-২২ বছর ধরে আমরা এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। এটি যতটা না প্রতিযোগিতা, তারচেয়ে বেশি গ্রামবাসীর মিলনমেলা। আমাদের গ্রামের যারা ঢাকায় থাকেন তারাও বিশেষ দিনটি উপলক্ষে বাড়িতে আসেন। অনেকের আত্মীয়স্বজনরাও এই উপলক্ষেই বাড়িতে বেড়াতে আসেন। এটি যদি আমরা যুগ যুগ ধরে ধরে রাখতে পারি, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে।'

প্রতিযোগিতা শেষে পুরস্কার বিতরণী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

গ্রামের আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ তারেক বলেন, 'এখন তো শিশু-কিশোররা সবসময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এমন নিখাদ আনন্দ বিনোদনের সুযোগ তারা খুব কমই পায়। এমন আয়োজন শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্যও খুব জরুরি। আমাদের মধ্যে অনেকে যারা শহরে থাকেন তারা ঈদের দিনে বাড়িতে আসার সুযোগ না পেলেও এই দিনটি কোনোভাবেই মিস করতে চান না।'

রাত ১০টায় আয়োজিত নানা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সব বয়সী মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় উঠে গ্রামের বৈঠকখানা। ধীরে ধীরে আনন্দ উৎসবের সমাপ্তি নামতে থাকে। সবাই নিজ নিজ বাড়ির পথ ধরে, কিন্তু সবার চোখে মুখে থেকে যায় আনন্দের রেশ।   

Comments

The Daily Star  | English

FDI rose 20% in FY25

Bangladesh saw a rebound in foreign direct investment (FDI) in the fiscal year (FY) 2024-25, with net inflows reaching $1.71 billion.

1h ago