বইমেলা বিশেষ-৩

সংকটে যার অবস্থান নাই তাকে লেখক মনে করি না

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. কুদরত-ই-হুদার বই জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ: বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। 

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. কুদরত-ই-হুদার বই জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ: বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা। বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। 

বইমেলা, নতুন বই ও নিজের গবেষণা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

একুশে বইমেলায় অসংখ্য বই প্রকাশ হয়। মেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনায় থাকে অনেক ভুল। এই ক্ষেত্রে কীভাবে পাঠক বই নির্বাচন করবে?

কুদরত-ই-হুদা: বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বই বেচাকেনার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম বইমেলা। এটা ভালো আবার খারাপ। ভালো, কারণ এ মাসে প্রচুর বই বিক্রি হয়। খারাপ, কারণ এর বাইরে সারাবছর বই বিক্রি কম হয়। এর সাথে আমাদের পাঠাভ্যাসের ঊনতার একটা সম্পর্ক আছে।  এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে বই পড়ার সংস্কৃতি চালু হয় নাই। আগে যা-ও ছিল তা এখন ভয়াবহভাবে কমেছে। 

তবে মেলাই যেহেতু বই বিক্রির সবচেয়ে বড় মৌসুম সেহেতু প্রকাশকরা এই সময় বই প্রকাশ করার জন্য হাভাতেপনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। লেখকের তরফ থেকেও ব্যাপারটা তাই-ই। পাড়াপাড়ি করতে গেলে যেমন হাত-পা ভাঙার সম্ভাবনা থাকে, বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়; ভুলভাল হয়, হবেই। এটা ঠেকাতে পারবেন না।

তবে হ্যাঁ, ভালো প্রকাশনী বলে একটা কথা আছে। এদের বইয়ে ভুল কম থাকে। কারণ তাদের কিছুটা হলেও জনবল বেশি থাকে। থাকে পেশাদারিত্ব। সুনামজনিত দায়ও অবশ্য বেশি থাকে। তবে ভালো প্রকাশনী কোনটি তা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। এটা শুধু স্টলের আকার আকৃতি আর বইয়ের সংখ্যার ব্যাপার না। আজকাল অনেক ছোট ছোট নতুন প্রকাশনী নির্ভুল সুন্দর সুন্দর আন্তর্জাতিক মানের বই বের করছে। শুধু দেখনদারি নয়, বিষয়ের দিক থেকেও অভিনব সেগুলো। ফলে, মেলায় গেলে ঘুরে দেখে শুনে বই কিনলেই ভালো বইটি চোখে পড়বে বলে মনে করি।

আর দুচারটা বানান ভুলকে আমরা বড় ভুল বলি না। কলকাতার দে'জ থেকে জসীম উদ্‌দীন রচনাবলি বের করেছে। বইয়ের কভার পৃষ্ঠাতেই জসীম উদ্‌দীনের নামের বানান ভুল। তাই বলে কি আমরা জসীম উদ্‌দীন পড়ছি না সেই বই থেকে! পড়ছি। কিন্তু সাবধানে পড়ছি- এই আর কি!

বাংলা একাডেমি থেকে আপনার গবেষণা বইটি প্রকাশিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ: বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবিতা শিরোনামে। কাজটির আলাদা বৈশিষ্ট্য কী?

কুদরত-ই-হুদা: আমি মনে করি, ষাটের দশকের কবিতায় জাতীয়তাবাদী চেতনার খোঁজ-খবর করার উদ্দেশ্য নিয়ে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিশেষ কোনো গবেষণা হয় নাই। দ্বিতীয়ত, যা কিছু হয়েছে তা মূলত ইতিহাসভিত্তিক। সেগুলো যতটা ইতিহাসভিত্তিক ততটা কবিতাভিত্তিক নয়। আমি কবিতায় ফোকাস করতে চেয়েছি; রাজনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাস আছে কিন্তু কবিতার তলে।

এই গবেষণায় অসংখ্য কবিতার নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছি। অবশ্যই তা জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা। আরো যে কাজটি করতে চেয়েছি তা হচ্ছে, আমাদের এখানে চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে-দুটি জাতীয়াবাদী চেতনা ক্রিয়াশীল ছিল সেই দুটি চেতনাকে বাইনারির হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছি। মানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঘৃণার ভেতর দিয়ে মুখোমুখি করে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ তো বিদেশি লোকরা করে নাই। যে দেশের মানুষের ভোটের ফল পাকিস্তান, সে দেশের একটা অংশ মানুষ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী ছিল। এটা হতে পারে। কিন্তু একাত্তর পর্যন্ত বাঙালির যে জাগরণ ঘটল সেই জাগরণটার সাথে শেষ পর্যন্ত ওই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী চিন্তার মানুষদের একাত্ম হতে না পারাটা অস্বাভাবিক। বিষয়গুলোকে এভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। ইতিহাসে এবং কবিতায় বাঙালির অভিযাত্রাটি ধরতে চেয়েছি, বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছি।

আপনার লেখা ও বলায় আপনি একটা অবস্থানে বা সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বোঝাপড়া কীভাবে রপ্ত করলেন?
কুদরত-ই-হুদা: লেখকের অবস্থান ছাড়া লেখা হতে পারে- আমি তা মনে করি না।  অবস্থান ছাড়া কীভাবে কেউ লেখে তা আমার জানা নাই। সংকটে যার অবস্থান নাই তাকে লেখক মনে করি না। হতে পারে তিনি অন্য অনেকের জন্য জরুরি।

তবে অবস্থান বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। এক. প্রচলিত মূলধারার দাপুটে আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের পক্ষে অবস্থান। এটার পক্ষে শর্তহীন, অপর্যালোচনামূলক অন্ধ অবস্থান যারা নেয় আমি তাদের বলি বাজাইরা লেখক। এই অবস্থান আরামদায়ক। আরাম করা লেখকের কাজ না। আমি তাকেই লেখক বলি, যার লেখায় নিজের জখম ও সংগ্রামের চিহ্ন থাকে। তা যার নাই তিনি কেমন লেখক তা আমার জানা নাই!

প্রশ্নের শেষ অংশে যে 'বোঝাপড়ার' কথা বললেন সে প্রসঙ্গে আসি। বোঝাপড়াই তো চিন্তা। চিন্তাচর্চা করতে হলে আপনাকে চারপাশের সাথে একটা বোঝাপড়ায় লিপ্ত হতেই হবে। বোঝাপড়া রপ্ত হয়েছে কি না জানি না। এটা একটা দীর্ঘ চর্চার ব্যাপার; চৈতন্যের পরিগঠনেরও ব্যাপার বোধ করি। রপ্ত করা ব্যাপারটার সাথে ভাষার বা গদ্যের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আমি বলব, চিন্তা নিজেই ভাষা বেছে নেয়। তবে হৃদয়বাদী গদ্য লিখতে পছন্দ করি। হৃদয়কে যুক্তি ও তথ্যে যাচাই করে নেয়া আমার লেখালেখির প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করি। কারণ, শুধু হৃদয়বাদিতা অনেক সময় ভাবালুতায় রূপ নেয়। ভাবালুতা আমি ঘৃণা করি; সহ্য করতে পারি না; সেটা জীবনেই হোক আর লেখালেখিতেই হোক।   

প্রবন্ধে আপনার চিন্তাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কবিতার বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

কুদরত-ই-হুদা: এই বিষয়ে বলার আগে, বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসের একটা রেখাচিত্র আঁকা জরুরি। বর্তমানে যেটাকে আমরা বাংলাদেশের কবিতা বলি তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল চল্লিশের দশকে। ওই দশকের প্রধান প্রবণতা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের ঢেউকে রূপায়িত করা। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকের কবিতা মূলত কলকাতা এবং ইউরোপের গলি-ঘুপচিতেই চোঁ চোঁ করে বেড়িয়েছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, ওইসব কবিতা বিদেশি কবিতা। কবিতা কখনো বিদেশি হয় না, হতে পারে না। এটা হলো একটা ঝোকের ব্যাপার। পঞ্চাশের বাংলাদেশের কবিতার প্রধান ঝোকটা ছিল ওই দিকে।

ষাটের দশকের বাংলাদেশের কবিতায় স্বদেশ ও বিদেশের তীব্র আলোড়ন লক্ষ করা যায়। কিন্তু স্বদেশের পাল্লাই বেশি ভারি বলে মনে হয়। অথবা আমরাই আমাদের ইতিহাসের নির্মাণের খাতিরে বিদেশি কবিতার ওই সময়ের ধারাকে প্রায় কবর দিয়ে দিয়েছি বা প্রত্যাখ্যান করেছি। বিদেশি বলতে বোঝাচ্ছি, স্যাড জেনারেশন, হাংরি জেনারেশনের প্রভাবের কথা। যাহোক, মোটাদাগে স্বদেশ আার স্বদেশের সংকটই ষাটের কবিতাকে শাসন করেছে।

সত্তরেরও প্রধান সুর আসলে ওইটাই; স্বদেশ আর স্বদেশের সংকট সম্ভাবনা, রাজনীতি এইসব। তবে ষাট আর সত্তরের কবিতার মধ্যে বিষয় ও প্রকরণের পার্থক্য ততটুকু স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে পার্থক্য যতটুকু। আশির দশকে এসে বাংলাদেশের কবিতা এই তিন দশকের কবিতার অভিজ্ঞতাকে এক ধরনের প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছে। বা বলা যায় আবার পঞ্চাশের কবিতার চরিত্র অর্জন করেছে। আশির কবিতার পাল তোলা হয়েছিল কলকাতার দিকে। এর ভেতর দিয়ে এই দশক বহু মানুষের কোলাহল থেকে কবিতাকে মুক্ত করে 'কবিতার মধ্যে' ফেরাতে চেয়েছিল। নব্বই মূলত এরই এক্সটেনশান। কিন্তু এই এক্সটেনশনের মধ্যেও কেউ কেউ টেনশন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তারা ভাষায়, ভাবে, প্রকরণে বেশি বেশি বাংলাদেশে থিতু হতে চেয়েছিল। কিন্তু খুব যে পাত্তা পেয়েছে তা না। আমি মনে করি গত কুড়ি বছরের কবিতা ওই ষাট, সত্তর, আশি আর নব্বইয়ের দারুণ সংশ্লেষ। এই কবিতা পুনরায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছে। প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন, সাংস্কৃতিক রাজনীতি তো বটেই, রাষ্ট্রীয় রাজনীতি সচেতনও বটে। প্রকাশে অকপট এই কবিতা প্রকরণে ও বিষয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সচেতন ও দেশাল।

আপনি গবেষণায় 'মহাকবি মধুসূদন পদক ২০২৩' পুরস্কার পেয়েছেন। কাজের জন্য এমন পুরস্কার কতটা সহায়ক? 

কুদরত-ই-হুদা: পুরস্কার কখনো কাজে সহায়ক হয় না। কারণ, যিনি লেখেন তিনি লেখেন কেন- ব্যাপারটা বুঝতে পারলে কথাটা পষ্ট হবে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে। সবাই কি লেখে? লেখে না। কেন লেখে না? কারণ, না লিখলেও তার চলে। কিন্তু যিনি লেখেন, আসলে তিনি বাধ্য হয়েই লেখেন। না লিখে তিনি পারেন না। তার কিছু কথা আছে, ভাবনা আছে, জীবন-জগত সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এগুলো লেখার মাধ্যমে প্রকাশ না করলে তার বেঁচে থাকাটাও অর্থহীন লাগতে পারে। তাই তিনি লেখেন। আমিও এক প্রকার বাধ্য হয়েই লিখি। ফলে পুরস্কার আমাকে দিয়ে লেখাতে পারবে না। বা লেখার সহায়ক হতে পারবে না।

তবু পুরস্কারের একটা ব্যাপার আছে। এটা হচ্ছে এক প্রকার স্বীকৃতি। যে/যারা পুরস্কার দিচ্ছে, সে/তারা কেন আপনাকে পুরস্কার দিচ্ছে? এজন্য দিচ্ছে যে, তারা মনে করছে, আপনি যা লিখছেন বা বলছেন তা তাদের কাছে অর্থপূর্ণ মনে হয়েছে। তাদের মনে হয়েছে আপনার লেখালেখিটা দেশ-দশের কাজে লাগছে বা এরকম কিছু একটা। তার মানে আপনি পুরস্কারের ভেতর দিয়ে আপনার পাঠকদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন। পুরস্কার কাজের সহায়ক হচ্ছে না। একটা সেতুর কাজ করছে। মাঠে খেলোয়াড়রা খেলে, দর্শকরা তালি দেয়। তালি দিলেই খেলা যদি ভালো হতো সবাই লোক ভাড়া করে খালি তালিই দেয়ার ব্যবস্থা করত। কিন্তু একথা সত্য, তালি খেলোয়াড়কে খেলতে সহায়তা না করলেও কিছুটা উৎসাহিত তো করেই।

Comments