বুক রিভিউ

চাদরে মোড়ানো নিঃসঙ্গতার গান

দুরদানা মতিনের প্রথম কবিতার বই সেরেনেইড ও নিঃসঙ্গ পাখিটি। নামের মধ্যেই রয়েছে অসামান্য কাব্যিকতা। পাঠক যত অগ্রসর হবেন, ক্রমেই আবিষ্কার করতে থাকবেন কবি কিভাবে অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন এবং শৈল্পিকতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিটা পংক্তিতে।

নিঃসঙ্গতার আভাস পাওয়া যায় শিরোনাম থেকেই। কবিতা পাঠের মাধ্যমে পাঠক নিঃসঙ্গতার মাঝে আটকে থাকে। বইটি যেন নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়ানো। প্রতিটা শব্দ যেন নৈঃশব্দ আর নিঃসঙ্গতার পসরা সাজানোর জন্য সমস্ত আয়োজন করতে প্রস্তুত হয়ে আছে। কবি লিখেছেন-

এখানে বাতাসে মোহন সুর,
থমকে দাঁড়িয়ে কাল তার হাত ধরে।
বিষাদের ভারে দুলে ওঠে মন–
জানি কোনো ছবিই চিরস্থায়ী নয়–
স্মৃতিরাও একদিন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

কবি তার তুলিতে অশ্রু, বিষাদ ও বেদনার রঙ মেখে জীবনের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। এখানে স্থায়ী-অস্থায়ী ভাবনার শক্তিশালী উচ্চারণ লক্ষ্য করার মত। আর স্মৃতি নিয়ে মানুষ আর কতকাল টিকে থাকার ভান করতে পারে। বিষাদের ব্যাবচ্ছেদ করে স্মৃতিরাও নিঃসঙ্গ হয়ে নৈঃশব্দের কাছে ফিরে যায়। "ঘরহীন" কবিতায় স্মৃতি আর নিঃসঙ্গতার অন্যরূপ ফুটে উঠেছে-

আমার হৃদয় বহু পুরাতন,
সেখানে শত জন্মের স্মৃতিদের
নিঃসঙ্গ কারাবাস;
অশান্ত, যাযাবর হৃদয় আমার,
আমার কোন ঘর নেই।

ঘরহীনতার অনুভূতি কবিদের নিত্যদিনের অনুভূতি – যেন এ অনুভূতির ভেতর দিয়ে কাটে তাদের প্রতিটা মুহূর্ত। একই সাথে কবিদের হৃদয় অস্থির ও অশান্ত, যেন কোথাও কোন প্রকৃত শব্দরাজি নেই যেগুলো ভালোবাসার বার্তা বহন করে। জীবন যাযাবরদের মত, ঘরে ফেরার তাড়া নেই। স্মৃতির কারাগারে বসবাস, কারাবাসই নিয়তি। জীবন আটকে থাকে কোন এক অজানা ও অদ্ভূত বিস্ময়ে।

প্রথম কবিতা "দেরি হলো কি" দূর্দান্ত উত্তাপময় শব্দের পর শব্দের গাঁথুনিতে উজ্জ্বল। পাঠক হিসেবে মনে হয় কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেছেন। অনেক কিছু বদলে দেবার প্রয়াস। আবার তার মধ্যে দ্বিধার অনুপ্রবেশ। জীবনের অর্থ বুঝতে প্রচেষ্টা আছে, কিন্তু আবার সবকিছুতে অর্থহীনতার ব্যাপ্তি, অথবা যা-কিছু ঘটছে তা যেন নিতান্তই "পুনরাবৃত্তি"। "বিলম্বিত বিদায়ের সুর বাজে অবিরাম" পাঠককে ঠেলে নিয়ে যায় শীতল অনুভূতির অতল গহবরে।

মৃত্যু নিয়ে অনেক পংক্তি পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি কবিতায়। যেমন "অনন্তকালের খেলা" কবিতায় বলা হচ্ছে, "মৃতদের অভিমান থাকে না, থাকতে নেই। / আমি একাধারে মৃত ও জীবিত"। অসাধারণ উচ্চারণ। একজন প্রাণসঞ্চারিত ব্যক্তি মৃতদের সারিতে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখছে। তিনি দেখছেন পৃথিবীর তথাকথিত জীবিতদের আস্ফালন, তাদের লাভ-লোকসানের হিসেব। আবার পাঠক নিবিড় নৈঃশব্দের শব্দ শুনতে পায় যখন উচ্চারিত হয়, "নিজেকে দুভাগ করে আলাপ করি পরস্পর"।

কবি কখনো কখনো নৈরাশ্যবাদের আশ্রয় নিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। চারপাশের অন্ধকার যখন মনোজগতের প্রতিটি কোণায় রাজত্ব করতে চায়, তখন দিগন্তে কেউ ভোরের সূর্যোদয়ের প্রথম আভাটি আর দেখতে পায়না। আকাশ যেন তার নিত্যদিনের শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে অন্যভাবে নিজের অবস্থান জানান দিতে চায়।

কবি লিখেছেন,
বুকের ভেতর এখন গভীর শীতের রাত,
এখানে বরফ পড়ে না,

.......
আমি জীবনেও নেই, মৃত্যুতেও নেই।
জয়গান এখন বিবেকহীন নির্লজ্জদের।

কবি এমন এক পৃথিবীর কথা বলছেন যেখানে রাত হয় দিনের মত করে আর দিন রাতের মত, যেখানে অন্ধরা বেশি দেখে, আর আলোকিতরা পাথর নিশ্চুপ। আইরিশ কবি ইয়েটস-এর ছায়া লক্ষ্য করা যায়। এটি এমন এক স্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে যেখানে কবিতার ভাষাকে অন্য অর্থ প্রদান করা হয়, যেখানে কবিতা আর অকবিতার পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। এক নির্মম সময়, এক নিষ্ঠুর পৃথিবীর মুখোমুখি মানুষ। এখানে এখন বসন্ত নেই, এখানে বরফও নেই। এখানে ফুল ফোটেনা, এখানে পাখিদের নিরবতা বিরাজ করে। এখানে জীবন যেমন, মৃত্যুও ঠিক তেমনি।

কবি তার নিজের সঙ্গে কথোপকথনের কথা বারবার বলার চেষ্টা করেন। তার মনের ভেতর, তার মস্তিস্কে অবিরাম বয়ে যায় কথার নদী। কে বক্তা আর কে শ্রোতা তা নিরূপণ করা যেন অর্থহীন। যেমন কবি লিখেছেন,

স্বপন আর বাস্তব মিলে মিশে একাকার;
সাথে বিশ্বাস, অবিশ্বাস,
প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত, অতীত আর বর্তমান।
মস্তিস্কের ভেতর বিরামহীন কথোপকথন। (নিষিদ্ধ গোধূলির দেশ)

কবি এমন এক পরিস্থিতি আর পরিবেশের কথা বলছেন যেখানে কল্পনা আর দৈনন্দিন জীবনের পথচলার তফাৎ নির্ণয় করা সহজ নয়, বরং অসম্ভব – এমনটাই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মানুষ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে, যেন দিকভ্রান্ত পথিক পথের সন্ধানে বেরিয়ে আবারো পথহারা। হাজারো প্রশ্ন কিন্তু কোন উত্তর জানা নেই। ঘূর্ণিপাকের মত কিছু একটা অস্থির করে তোলে মনোজগৎ; আর মস্তিষ্ক হয়ে যায় লাশবাহী গাড়ীর সাইরেন। শুধু কথা চলতে থাকে যার কোন শুরু নেই, শেষও নেই।

নির্দ্বিধায় বলা যায় দুরদানা মতিন আচ্ছন্ন হয়ে আছেন জীবনানন্দের ক্লান্তিতে, যে-কারণে স্তব্দতা ঘিরে ধরে, নিঃসঙ্গতা সঙ্গী হয়, নৈঃশব্দ গান গায়। কবি যে দেশের কথা বলছেন সেটাতো নিষিদ্ধ এবং একি সাথে তার রঙ গোধূলির আকাশের মত। এখানে মানবকুল অদৃশ্য, ছায়ার মত – শুধু মৃদু শব্দ পাওয়া যায়, দেখা যায়না। শব্দ? সেটাও কান্নার। কালেভদ্রে মৃদু হাসির শব্দও আসে।

বদলেয়ারের কাছে জগতটা একটা হাসপাতালের মত হয়ে উঠেছিল। এ কবি বলেছেন বাতাসে ঔষধের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তাহলে কবি মতিনও কি একটা অসুস্থ পৃথিবীর কথা বলছেননা যেখানে মানুষ নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে শুধু ঔষধ খেয়ে খেয়ে? আর পৃথিবী নামক হাসপাতালে মানুষ নামক রোগীরা ঔষধের উপর নির্ভরশীল। তাই বোদলেয়ারের মত কবি  বাতাসে ঔষধের গন্ধ পান। "নিষিদ্ধ গোধূলির দেশ" একটা অসাধারণ সৃষ্টি।

সেরেনেইড ও নিঃসঙ্গ পাখিটি একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ। যেখানে মানুষের জীবনযাত্রার সংকট উঠে এসেছে। এসেছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক সংকটের চিত্র। এর মধ্যে মনোজগতের মাঝে বিরাজমান অস্থিরতা তীব্রতর বলে প্রতীয়মান হয়। কবিতাগুলোতে ক্লান্তি, হতাশা, গ্লানি, বিষাদ এবং অবসাদের কথা এসেছে বারবার। যদিও নিঃসঙ্গতা ও নৈঃশব্দ সেরেনেইড-এর ইসেন্স, অন্যান্য বিষগুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করার মত। নির্দ্বিধায় বলা যায় কাব্যগ্রন্থটি কবিতার পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Rangpur mob violence victims’ families decry police inaction

Four arrested, some culprits have gone into hiding, local police say

41m ago