প্রশ্ন না করার সংস্কৃতি সমাজকে কোনদিকে নেয়?

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

একবার এক কর্মশালায় গেছি। সেখানে নানান পেশার, নানান কিসিমের লোক। কর্মশালা পরিচালনা করছিলেন যারা, তারা মাঝে মাঝেই নানারকম প্রশ্ন চাইছিলেন। আয়োজকদের উদ্দেশ্য ছিল, যা তারা শেখাতে চাইছেন, তা ঝালিয়ে নেয়া হোক অংশীজনদের নানান প্রশ্নের মাধ্যমে। কিন্তু মুশকিল হলো, প্রশ্নকর্তারা কেউই প্রশ্ন করছেন না, প্রশ্ন করতে দাঁড়িয়ে বরং ছোটখাট বক্তৃতাই দিয়ে ফেলছেন। অয়োজকরা নানারকম কলাকৌশলের আশ্রয় নিলেন বটে কিন্তু কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া গেল না।

পরে এ নিয়ে আমরা বিস্তর আলোচনা করেছি। নানা রকম পরিবীক্ষণও চালিয়েছি। দেখেছি আমাদের এই সমাজে বা রাষ্ট্রে বা পরিবারে বা বিদ্যায়তনে আসলে কোথাও প্রশ্নকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয় না। প্রশ্নকে আদোতে আমরা ভয়ই পাই। যাতে কোন কিছু নিয়েই প্রশ্ন না ওঠে সারাক্ষণ আমাদের সেই চেষ্টাতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এই প্রশ্নচাপা দেবার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন আসলে আমাদের পঙ্গুই করে ফেলেছে, ফলে প্রশ্ন করতে দাঁড়িয়ে আমরা বড়সড় এটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেও মূল প্রশ্নটা করতে পারি না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রশ্নকে আমরা ভয় পাই কেন? কেন আমরা আমাদের সকল প্রতিষ্ঠানে প্রশ্ন চালু করতে চাই না। প্রথমত, প্রশ্ন করতে সুযোগ দিলেই, প্রশ্ন যদি যথাযথ হয়, তাহলে তার একটা যুৎসই উত্তরও দরকার। যুৎসই উত্তর তখনই মিলবে, যখন আমরা একটা সঠিক কাজের আবহ রাখব। আমরা যদি সঠিকভাবে নিয়ম মেনে সঠিক কাজটি করতে পারি, তবে আমাদের কাছে সেই কাজের বিষয়ে যে কোন ধরণের প্রশ্ন আসলে, যুৎসই একটা জবাব থাকবেই। এই নিরীক্ষা সঠিক মানলে, আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, আমরা সঠিক কাজ সঠিকভাবে করি না। সে কারণেই প্রশ্নকে আমরা ভয় পাই। প্রশ্নকে আমরা এড়িয়ে চলি।

দ্বিতীয়ত, সঠিক প্রশ্ন আমাদের অযোগ্যতাকে উম্মোচন করে দেয়। সঠিক জায়গায় সঠিক লোক সঠিকভাবে নিয়োগ না পেলে, যোগ্য লোকের বদলে অযোগ্য কেউ আসন দখল করে বসে থাকলে, যে কোন যুৎসই প্রশ্নে তো তার কুপোকাৎ হবার কথা। সেইরকম লোকই তো আমাদের চারপাশে বড্ড বেশি। ফলে অযোগ্যতা ঢাকতে আমরা প্রশ্নকে নিরুৎসাহিত করি।

তৃতীয়ত, ভক্তিবাদ বা প্রশ্নহীন বিশ্বাস ভয় পায় প্রশ্নকে। ভক্তিবাদ বা তোষণবাদের যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা, সেখানে প্রশ্নহীন আনুগত্যই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। ফলে ভক্তি বা প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রশ্নকে ভয় পায়। সে কারণেই বিশ্বাসীর ধর্মে প্রশ্ন করা বারণ। অবশ্য যদি প্রকৃত ধার্মিক হন, তার তো প্রশ্নকে ভয় পাবার কথা নয়। বরং নিয়তই তিনি প্রস্তুত থাকেন সৃষ্টিকর্তার শক্তিতে, প্রশ্ন কেন কোন কিছুতেই তার ভয় পাবার কথা নয়। তাহলে আমরা এটাও বলতে পারি, প্রকৃত ধার্মিক নন, বকধার্মিকরাই ভয় পান প্রশ্নে।

চতুর্থত, প্রশ্ন সাহসী লোকের কারবার। মেরুদন্ড সোজা করে যারা জীবন ও জগৎকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, সেইসব সাহসী লোক প্রশ্নকে আলিঙ্গন করেন, অকুতোভয় সাহসে। ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়, বারংবার। ফলে ভীতু লোকের কাজ নয় প্রশ্নকে মোকাবিলা করা। প্রকৃত ধার্মিক, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা যত কমেছে, প্রশ্ন না করার সংস্কৃতি ততই বেড়েছে। ফলে একথা বলা যায়, ভয় আমাদের প্রশ্নকেও থামিয়ে দিয়েছে।

এইরকম হাজারটা কারণ আমরা বের করতে পারি, প্রশ্ন থামিয়ে দেবার কারণ খুঁজতে যেয়ে। কিন্তু উল্টো করে ভাবলে দেখা যাবে, এই পৃথিবীর তাবৎ অগ্রযাত্রা, কি ধর্মে, কি বিজ্ঞানে, কি মানবতায়, কি বাণিজ্যে, কি আবিষ্কারে সর্বত্রই বড় নিয়ামক হচ্ছে 'প্রশ্ন'। নিউটনের আপেল পড়া থেকে শুরু করে পৃথিবী বানিয়েছে কে, পয়গম্বরের এই খোঁজাখুঁজির মূলেও আছে নানাবিধ প্রশ্ন। প্রশ্ন থেকেই তাবৎ জ্ঞানের উৎপত্তি। প্রশ্ন দিয়েই গৌতম বুদ্ধের মানবতাবাদের উত্থান। প্রশ্নই তাই আসলে আমাদের সকল শুভবোধের মূলসূত্র।

কি, কেন, কোথায়, কখন-এসব প্রশ্নবান হেনেই যে জাতি ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর খুঁজতে, ঝাপিয়ে পড়েছে জল-জলা-জংলায়, পাড়ি দিয়েছে সাগর-নদী-সমুদ্র, সেই জাতির হাতেই নির্মিত হয়েছে সভ্যতা। হালফিলে যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনায়করা তার জনগণের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে বানিয়ে রেখেছেন নানারকম সিস্টেম, সেই রাষ্ট্রকেই আমরা বলছি উত্তম রাষ্ট্র। তারাই শাসন করছে জীবন ও জগৎ, মাতব্বরি করছে তারাই অন্য রাষ্ট্রের ওপরেও। ফলে, প্রশ্ন এক আদি নির্মাণ করণসূত্র। প্রশ্নকে এড়িয়ে, প্রশ্নকে পাশ ফিরে যাওয়া মানেই-নিজেদের শক্তিতে ক্রমাগত ক্ষয়ে ফেলা। আমাদের সমাজ রাষ্ট্র বা বিদ্যায়তন সর্বত্র সেই রোগে আজ রোগাক্রান্ত। আমরা প্রশ্নকে ভয় পাই বলে, প্রশ্ন যাতে না ওঠে, তার জন্য বানিয়ে ফেলছি একের পর এক প্রতিষ্ঠান। সেখানেই বিনিয়োগ করছি বিপুলতর। প্রযুক্তি আর পয়সা দুটোই ঢালছি দেদারসে, প্রশ্নকে থামিয়ে দিতে। তাই আমাদের দূরবাসের লেখকরা ভয়ে ভয়ে লিখেছেন 'ভয়ের সংস্কৃতির' কথা। ফলে আজ সকলপ্রকার ভয় তাড়াতেও প্রশ্নকেই আলিঙ্গন করার ব্যবস্থা নির্মাণ দরকার।

বলা যায়, আমরা যদি জাতি হিসাবে বড় হতে চাই, রাষ্ট্র হিসাবে সুসংঘবদ্ধ হতে চাই, সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলায় সৃষ্টিশীল হতে চাই, আমাদের প্রশ্নকে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের পরিবারে আমরা সকল শিশুকে যেভাবে ধমকে-চাপকে তার অজস্র প্রশ্নের কৌতুহলী মনকে বিনষ্ট করে প্রশ্ন মারতে চাই, সেই সংস্কৃতি থেকে বেরুতে হবে। নিজে প্রশ্ন করতে হবে, অন্যকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে হবে, বহুজনের প্রশ্ন মনোযোগের সাথে শুনতে হবে। প্রশ্ন করার ও প্রশ্ন শোনার এক বড় সংস্কৃতির জনজোয়ার যাতে তৈরি হয়-সেই ভাবনাটাই ভাবতে হবে।

প্রশ্নহীন ভয়পাওয়া আনুগত্য ও দলদাসে ভরা সহমত জীবন আদোতে কোন জীবন নয়-এই বোধটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই ছড়িয়ে দেবার, ছাড়িয়ে দেবার যোগসূত্র টানতেই আমাদের সম্মিলিত আয়োজন, মনন নির্মান মানস দরকার।

সেটা কীভাবে গড়ে উঠবে, প্রশ্ন বা লড়াই সেটাই।

দুই.

প্রশ্ন করার সংস্কৃতি আমরা বানাবো কীভাবে? এটা কী আমাদের রাজনীতি তৈরি করে দেবে? নাকি তা আহরণ করবো সংস্কৃতির পাটাতন থেকে। নাকি আমাদের মিডিয়া জগতের নব নব আয়োজন আমাদের উদ্ভুদ্ধ করবে এই আয়োজন সম্পন্ন করতে। আবার প্রশ্ন করার পরের পরিস্থিতি কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে। প্রশ্ন করার পর 'আয়নাঘর' যদি হয় নিয়তি, তাহলে তো বিপদ। কিংবা প্রশ্ন করার অপরাধে চাকরীই যদি চলে যায় সাংবাদিকের তাহলে নব নব প্রশ্ন নির্মিত হবে কীভাবে?

এসব ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্র আর তার জনগণের সম্পর্কও। জনগণকে রাষ্ট্র কিভাবে দেখে। রাষ্ট্র বলতে তো আসলে তার প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানকে যারা চালায় তাদেরকেই বোঝায়। ফলে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান যারা চালান সেই ব্যক্তিরা জনগণকে কি দৃষ্টিতে দেখছেন বা জনগণ রাষ্ট্রকে কিভাবে নিচ্ছে সেই ভংগিটাও বিবেচনায় নেয়া জরুরি। রাষ্ট্রে তার জনগণ যদি 'প্রজা' হয়ে থাকে তাহলে একরকম কথা। আর জনগণ যদি সেটা উৎরে 'নাগরিক' হয়ে ওঠে সেটা আরেক প্রশ্ন। এই প্রজা আর নাগরিক বিষয়ে একটা চমৎকার ব্যখ্যা আছে রণজিৎ গুহের লেখায়।

নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার গুরু রণজিৎ গুহ বলছেন, বস্তুত 'প্রজা'র সঙ্গে 'নাগরিকে'র মৌলিক তফাত এই যে, নাগরিকের অধিকার আছে, প্রজার নেই। প্রজার ভালো-মন্দ, মরা-বাঁচা সবই প্রভুশক্তির অনুগ্রহ নির্ভর। প্রভুর কাছে প্রজা প্রার্থনা করতে পারে, আবেদন করতে পারে, অবস্থা বিশেষে নালিশও জানাতে পারে; এককথায়, সে চাইতে পারে। কিন্তু সে দাবি করতে পারে না। কারণ, তার কোনও অধিকার নেই। অনুগ্রহ থেকে আবেদন হয়, নিবেদন হয়, কিন্তু অনুগ্রহের ভিত্তিতে দাবি করা যায় না।

রণজিৎ গুহের যুক্তি হচ্ছে, 'চাওয়া আর দাবির মধ্যে পার্থক্যের গুরুত্ব লক্ষ করা দরকার। দাবির মধ্যে থাকে বেশ একটা জোরদার অধিকারবোধ। এ দিক থেকে প্রজার সঙ্গে নাগরিকের তফাৎ। আবেদন, নিবেদন, নালিশ, প্রার্থনা, এই সবই প্রজার পক্ষে করা সম্ভব, কিন্তু দাবির জোর তাতে নেই। প্রজার সেই চাওয়ার সঙ্গে দাবির এই প্রভেদ ধারণাগত। দাবির মধ্যে যে নাগরিক অধিকারের ধারণা রয়েছে, তার সঙ্গে ক্ষমতার বৈষম্য খাপ খায় না। অথচ সে বৈষম্যই প্রজার সঙ্গে প্রভুর সম্পর্কের ভিত্তি, কেননা, তা হল দুর্বলের সঙ্গে বলবানের সম্পর্ক, বশ্যতা ও আধিপত্যের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের বশেই প্রজাকে প্রভুর অনুগ্রহ ভিক্ষে করতে হয়। নাগরিকতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তার উলটো।'

তিন.

রণজিৎ গুহে'র এই ভাবনা আমলে নেবার মত। কেননা, যে প্রশ্নটা দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল, যথার্থ প্রশ্ন করতে না পারার সমস্যা, সেটার মূল কিন্তু নিহিত আছে এই ক্ষমতাকাঠামোর প্রশ্নেই। এই ক্ষমতাকাঠামোই তো ঠিক করে দিচ্ছে অবস্থান। প্রজা না নাগরিক- রাষ্ট্রে কি অবস্থান হবে সেটা নির্ভর করছে তো ব্যক্তি এই ক্ষমতাকাঠামোতে কোন মেরুতে থাকছে তার ওপর।

ক্ষমতাকাঠামোতে বৈষম্য থাকলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হয়ে থাকছে জন্মগতভাবেই। পরিবার নির্ধারণ করছে তার ভবিতব্য। কেননা যে পরিবারে জন্মাচ্ছে সেই পরিবারের সামাজিক অবস্থান ও ক্ষমতা পরিমাপের ওপরেই নির্ভর করছে ব্যক্তির ভবিষ্যত। যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার তার ক্ষমতা কাঠামোর অবস্থান আমুল পাল্টে ফেলতে না পারছে, ব্যক্তির বেড়ে ওঠার সমস্ত অবয়ব গড়ে উঠছে সেই পরিবারের আর্থিক-সামাজিক শক্তির সমান্তরালেই। ব্যক্তি মাদ্রাসায় পড়বে না ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে নাবি যাবে ক্যাডেট কলেজে-সেটা নির্ধারণ করছে পরিবারের শক্তিকাঠামো। এই শিক্ষা, অর্থেই গড়ে উঠছে তার ভবিষ্যত। ফলে, রাষ্ট্রে সে প্রজার মত হয়ে থাকবে নাকি নাগরিক হয়ে উঠবে সেটার বীজ পোতা থাকছে এখানেই।

বলা ভালো বাংলাদেশ তার মধ্য পঞ্চাশ পেরিয়ে বহু সংগ্রাম-বিক্ষুদ্ধতা এড়িয়ে একটা জিনিস প্রমাণ করেছে- সে কোনভাবেই তার শিক্ষাব্যবস্থাকে আর কখনই একমুখীন হতে দেবে না। বাংলা-ইংরেজি-মাদ্রাসা এই তিন মাধ্যমকেই সে তার পরিণতি ভেবে নিয়েছে। এই বিভাজনই বাংলাদেশের নিয়তি।  

২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেরণা ছিল বৈষম্যবিলোপ কিন্তু বাস্তবে সেখানেও বিস্তর বৈষম্যই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। চলমান বৈষম্য ভাংবার জন্য যে রাজনৈতিক আদর্শ আর প্রশিক্ষিত নিবেদিত কর্মীবাহিনী লাগে সেটা গড়ে তোলা খুব সহজ কাজ নয়। আবার সেখানেও নানান ক্ষমতাকাঠামোর লীলাখেলা আছে। সেসব সংকট সামলাতে না পারলে আদোতেই কোনো বড় পরিবর্তন অসম্ভব। ফলে আমরা একটা গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি বারংবার। 

চার.

লেখাটা শুরু হয়েছিল প্রশ্ন করা সক্ষমতা নিয়ে। সেখানে রণজিৎ গুহের ভাবনা ঠেলে দিল ক্ষমতাকাঠামো আর বৈষম্য সম্পর্কিত সমীকরণে। সেটার সরলীকরণে তিনি দিয়েছেন প্রজা আর নাগরিকের শক্তির বয়ান। সেসব ঘাঁটতে যেয়ে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের নানারকম উত্থানপর্বের করুণ পরিণতি দেখে একটা গোলকধাঁধাঁ খুঁজে পেলাম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই গোলকধাঁধাঁ থেকে আমরা বেরুবো কী করে? পথ একটাই, সব ঠেলে আমাদের নির্মাণ করতেই হবে প্রশ্ন করবার কাঠামো। সেটাই বৈষম্যকে প্রশ্ন করবে, ক্ষমতাকাঠামোকেও প্রশ্ন করবে। প্রশ্ন করাটাই একমাত্র সমাধান।

রাষ্ট্র, সংবিধান, সংস্কার, ফ্যাসিবাদের বিচার, স্বৈরাচারের পুনরাগমন ঠেকানো বিষয়ে এখন ভাবনা হচ্ছে সর্বত্র। লড়াই বেধে গেছে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও। এই রাষ্ট্রনৈতিক ডামাডোল আমাদের অনেক গোপন কুঠিরও খুলে দিচ্ছে। হাওয়াটাকে শুধু বইতে দিতে হবে। এই গোলমেলে সময়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে প্রতিদিন, তার প্রবহমানতার পথটাকে খোলা রাখতে হবে। অনেক ভুল হয়তো হবে, বিপদ হয়তো আসবে কিন্তু প্রশ্ন করার পথটাকে জারি রাখতে হবে।

রাষ্ট্র আসলে মরে না তাকে বেঁচে উঠতেই হয়। সেই বারংবার বেঁচে থাকার পথ একটাই-প্রশ্ন করার সক্ষমতা। প্রশ্ন দেখলে চমকে উঠবে ক্ষমতার মসনদ, সেটাও যদি বহাল থাকে তবে রাষ্ট্র তার প্রজাকে নাগরিক বানানোর চেষ্টাতেই রত থাকবে।

পুনশ্চ: গণঅভ্যুত্থান পরবর্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখন এক জটিল দশা পার করছে। এখানেও নানা প্রশ্ন উঠছে। বিপ্লবস্নাত তরুণরা প্রশ্ন তুলছে রক্তপার করা জীবন নিয়ে। সংবিধান, রাষ্ট্র ,সংস্কার বিষয়ে প্রশ্ন করতে যেয়ে কখনও কখনও এমন সব বেয়াড়া প্রশ্ন তুলছে, বলছে নতুন স্বাধীনতার কথা, বলছে নতুন বন্দোবস্তের কথা। তারা যে খুব গ্রামার মেনে, স্বাত্ত্বিক জীবন বেয়ে সেসব প্রশ্ন তুলছে তা বলা যাবে না। কখনও কখনও চলমান কর্দমাক্ত জীবনে পা ডুবিয়েই প্রশ্ন তুলছে। সেসব প্রশ্নে ক্ষেপে যাচ্ছে প্রবীণেরা। কেউ কেউ তাকে ভাবছে 'ইঁচড়ে পাকামি'। কেউ কেউ তো আরও কর্কশ স্বরে মুত্র দিয়ে ভাসিয়ে দিতে যাচ্ছে সেই প্রশ্ন তোলা তরুণদলকেই।

সম্ভবত বাঙালি জীবনের দুঃখই এই যে, তারা রাষ্ট্র বিনির্মানের রক্তছেকা স্বপ্নকে নিয়ে যতটা আবেগড়তাড়িত হয়, বাস্তবে তার কেজো পরিণতি গড়তে ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়। কিন্তু বারংবার স্বপ্নভঙ্গের পরেও নতুন তরুণেরা এসে পুরাতন ভাংতে চায়। রক্তপাত-জীবনত্যাগ কোনকিছুতেই তাদের ঠেকানো যায় না। তাদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধ আসে, তারাই বিনির্মাণ করে নব্বই, তারাই রক্তে দিয়ে প্রাণের দামে আনে চব্বিশ। এবারও বাংলার রাষ্ট্রদশায় সকল সংস্কার, নতুন সংবিধানের স্বপ্ন ঠেকছে কেবলমাত্র নির্বাচনভাবনাতেই। 

এবারও সেই প্রবীণদল প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়েছে, তাই থামিয়ে দিতে চায় প্রশ্নকেই। ফলে একটা চক্রময় রাষ্ট্রনৈতিক জীবনেই ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা। বড় ও বুড়ো রাজনৈতিক দলগুলো আসলে জনগণকে 'প্রজা' বানিয়ে রাখতে চায়। 'নাগরিক' বানাতে পায় দারুণ ভয়। এই বাস্তবতা আছে, থাকছে কিন্তু প্রশ্ন করার লড়াইটাও রাখতে হবে। তরুণরাই ভরসা। তারাই আবার বারে বারে ফিরিয়ে আনবে ব্যর্থ বিপ্লবের অসুখী চেতনা, সেটাই আবার প্রাণ দেবে নতুনভাবে নতুন লড়াই তৈরির পাটাতন তৈরিতে। লেখাটা শেষ করছি রবীঠাকুরের কবিতা দিয়ে-

পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে

মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে

হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি-তব গৃহক্রোড়ে

চিরশিশু ক'রে আর রাখিয়ো না ধরে।

দেশশোন্তর-মাঝে যার যেথা স্থান

খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।

পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে

বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।

প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স'য়ে, আপনার হাতে

সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।

শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধ'রে

দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষীছাড়া ক'রে।

সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,

রেখেছ বাঙালি করে-মানুষ করনি।। [বঙ্গমাতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

Comments

The Daily Star  | English

India curbs import of Bangladeshi jute, woven fabrics, yarn

However, the products will be allowed to be imported only through Nhava Sheva seaport in Maharashtra

1h ago