পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যু: আদালতে দায়ের করা মামলা নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’

দুদক কর্মকর্তার মৃত্যু
দুদকের সাবেক উপপরিচালক মো. শহিদুল্লা। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক উপপরিচালকের মৃত্যুর পর তার বিরুদ্ধে আদালতে দায়ের করা মামলা নিয়ে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পরিবারের দাবি, এ ধরনের মামলার বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না, তবে স্থানীয় একজনের সঙ্গে জমি নিয়ে তাদের বিরোধ ছিল।

গত মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে দুদকের সাবেক কর্মকর্তা ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাকে (৬৮) গ্রেপ্তার করে চান্দগাঁও পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, শহীদুল্লার বিরুদ্ধে মারধর ও ভয় দেখানোর মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন আদালত।

তবে পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পরোয়ানা ইস্যু হওয়া মামলাটি মিথ্যা।

এ ঘটনায় বিধি বহির্ভূত কিছু হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখেতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়।

নিহতের পরিবার ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে ৩২৩ (মারধর) ও ৫০৬ (২) (ভয়ভীতি প্রদর্শন) ধারায় মামলা করেন রণি আক্তার তানিয়া (২৬) নামে এক নারী। মামলায় ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লা ও তার আত্মীয় মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ারকে আসামি করা হয়। এ মামলায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেন সংশ্লিষ্ট আদালত।

চান্দগাঁও থানায় ডাকযোগে পরোয়ানাটি থানায় আসে গত ১ অক্টোবর। পরোয়ানা তামিল করতে থানার এএসআই ইউসুফ আলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৩ অক্টোবর রাতে ইউসুফ আলী ও আরেক এএসআই মো. সোহেল ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান।

মামলার এজাহার অনুযায়ী, মামলাটি দায়ের করেছেন বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের রত্মপুর গ্রামের মোহাম্মদ হাশেমের মেয়ে রণি আক্তার তানিয়া। তার ঠিকানা নগরের এক কিলোমিটার এলাকায় দুলু মিস্ত্রির বাড়ি।

এজাহারে অভিযোগ করা হয়, গত জানুয়ারি থেকে তিন হাজার টাকা বেতনে তিনি ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লার বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। প্রথম দুই মাস বেতন ঠিক মতো দিলেও মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত তার বেতন বকেয়া ছিল। ১২ আগস্ট টাকা চাইলে ওই সপ্তাহের মধ্যে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন শহীদুল্লা। একই সঙ্গে তার ভবনের নিচতলায় থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন বলেও জানান। টাকা না দেওয়ায় ২৩ আগস্ট সকালে আবার টাকা চাইতে যান। এ সময় শহীদুল্লার স্ত্রী তাকে রাতে যেতে বলেন। রাতে টাকার জন্য গেলে শহীদুল্লা জানতে চান, কেন রাতে গেছেন। কাউকে রাতে টাকা দেন না বলে জানান।

এজাহারে আরও বলা হয়েছে, এ সময় তানিয়া তার মেয়ের জন্য দুধ কিনতে হবে, তাই টাকা ছাড়া যাবেন না জানালে শহীদুল্লা তাকে চড়-থাপ্পড় মারেন এবং ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এক পর্যায়ে তার নির্দেশে তার শ্যালক মোহাম্মদ কায়সার আনোয়ার তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন এবং বাসা থেকে বের করে দেন।

এ ঘটনায় থানায় মামলা না নেওয়ায় আদালতে মামলা করেন তানিয়া।

শহীদুল্লার স্বজনদের দাবি, এই নামের কেউ তাদের বাসায় গত কয়েক বছরে কাজ করেননি।

শহীদুল্লার ছেলে নাফিস শহীদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই মামলার বিষয়ে মঙ্গলবার রাতের আগে জানতামও না। কোনো নোটিশও আমরা পাইনি।'

তিনি আরও বলেন, 'স্থানীয় প্রভাবশালী একজনের সঙ্গে আব্বার জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ আছে। কিন্তু কোনো নারীর সঙ্গে তো কোনো সমস্যা নেই। যদি আদালতে এমন কিছু থাকতো, তাহলে তো আমরা জানতাম।'

'যার সঙ্গে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ চলছে তিনি প্রভাবশালী। তার ইন্ধনে যেকোনো কিছু হতে পারে। স্থানীয়রা আমাদের সেই জায়গায় চাঁদাবাজি করতো। আমার বাবা এর প্রতিবাদ করেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আমাদের এই দিন এসেছে', যোগ করেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী রবিউল হাসান ফয়সাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাচাকে সাদা পোশাকে দুই জন ধরে হাটিয়ে থানায় নিয়ে যান। খবর পেয়ে আমিসহ চাচার আরেক ভাই ও আরও একজন থানায় যাই। থানায় আমাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমরা ওষুধ নিয়ে গেলেও পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি। এর কিছুক্ষণ পর যিনি চাচাকে ধরে থানায় এনেছিলেন, তিনি রাস্তায় এসে সিএনজি খুঁজতে থাকলে আমাদের সন্দেহ হয়।'

'পরে এগিয়ে গিয়ে দেখি, চাচা টেবিলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন। আমরা তাকে ধরে পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে এলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পুলিশ আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় কোনো সাহায্য করেনি,' অভিযোগ ফয়সালের।

নাফিজ শহীদ বলেন, 'কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না দেখিয়েই সাদা পোশাকে এসে আমার বয়স্ক বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। তার বাইপাস সার্জারি হয়েছে। তার আগেও অপারেশন করা হয়েছিল। তিনি একজন জটিল হৃদরোগী, অথচ তাকে ওষুধ নিতে দেওয়া হয়নি। তাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তখন তিনি সুস্থ ছিলেন। থানার ভেতরে কী এমন হলো যে আমার বাবা লাশ হয়ে বের হলেন? আমরা এ ঘটনার বিচার চাই। আমরা মামলা করবো।'

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম বলেন, 'একটা সিআর মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানামূলে শহীদুল্লাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। থানায় আনার পর তিনি খারাপ লাগছে বলে জানান। তখন আমার কক্ষে এনে বসিয়েছি। তাকে থানায় আনার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাই ও স্বজনরা এসেছেন। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তার ভাইয়েরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানি না। কারণ, থানায় শুধু আদালত থেকে বাদী ও আসামির নাম, মামলা নম্বর ও ধারা লিখে পাঠায়।'

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়া হলে তানিয়া নামে এক নারী তা রিসিভ করেন। তার কাছে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কল কেটে দেন। এরপর একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

Comments

The Daily Star  | English

Inside the lives of ride-sharing drivers

On the bustling streets of Dhaka, where traffic moves like molasses and the air hangs heavy with exhaust fumes, a new breed of urban warriors has emerged.

13h ago