খণ্ডচিত্র

‘নির্বাচনের মতো নির্বাচন হইলে ভোট দিতাম’

‘কিসের ভোট? এত আয়োজন তো ব্যর্থ হয়ে গেল।’
বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচন ২০২৪
ঢাকা-১৮ আসনের রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের একটি ভোটকেন্দ্রের সকাল ১০টার পরের চিত্র। ছবি: স্টার

দুপুর আড়াইটা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন ঢাকায় একপ্রকার 'লকডাউনের' আবহ। নগরের প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহন কিংবা লোক চলাচল নেই বললেই চলে। এমন পরিবেশে কাকলী মোড় ঘুরে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার জন্য কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে ঢোকার মুখে কয়েকজন সিএনজি চালককে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

সংবাদপত্রের গাড়ি দেখে এই চালকদের মধ্যে দুইজন আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসলেন। কথায় কথায় আজকের ভোট নিয়ে তাদের মূল্যায়ন জানতে চাইলে একজন বলে উঠলেন, 'কিসের ভোট? এত আয়োজন তো ব্যর্থ হয়ে গেল।'

আপনি কি ভোট দিয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ওই সিএনজি চালক বললেন, 'নির্বাচনের মতো নির্বাচন হইলে দিতাম। বাসাবাড়ির সবাইরে নিয়া (কেন্দ্রে) যাইতাম।'

ওই চালকের সঙ্গে থাকা আরেকজনও এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বললেন কিছু একটা।

বিএনপিসহ সমমনাদের ভোট বর্জনের মধ্যে রোববার সকাল ৮টা শুরু হয় ভোটগ্রহণ। এর আগে ভোরে ৫টার দিকে ব্যালট পেপার বুঝে নেন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা।

কিন্তু শীতের সকালের শুরুর ভাগে কেন্দ্রে কেন্দ্রে যে ভোটার খরা ছিল, রোদ ওঠার পর দিনের মধ্যভাগ পেরিয়ে শেষভাগে এসেও সেই খরা কাটেনি।

 জাতীয় নির্বাচন ২০২৪
ভোটারের দেখা নেই। শীতের রোদে অলস সময় কাটাচ্ছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। ছবিটি উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে দুপুর ১২টায় তোলা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

এদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা-১৭ ও ১৮ আসনের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২৫টি কেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন এই দুই প্রতিবেদক। এর প্রতিটি কেন্দ্রের চিত্রই ছিল মোটামুটি একই রকম।

প্রায় সব কেন্দ্রের বাইরে প্রার্থীদের ক্যাম্প অফিসে কর্মী-সমর্থকদের খানিকটা জটলা দেখা গেলেও ভেতরের চিত্র ছিল পুরোপুরি বিপরীত। এই ২৫টি কেন্দ্রের কোনোটিতেই ভোটারদের লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়নি। ভিড় না থাকায় কাজের ব্যস্ততা ছিল না প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদেরও। আবার অনেক জায়গায় কেন্দ্র খুঁজে পেতেও বিপাকে পড়তে দেখা যায় কোনো কোনো ভোটারকে।

এদিন সকাল ১০টার পর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের ১৪ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মহাদেব কুমার দেবনাথ জানালেন, প্রথম দুই ঘণ্টায় তার কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র নয়টি। কেন্দ্রের মোট ভোটার ২ হাজার ৮২২ জন।

ঢাকা-১৮ আসনের এই কেন্দ্রসহ একই সময়ে এখানকার আরও তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণের হার ছিল ১ শতাংশের খানিকটা বেশি।

এখান থেকে আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি কেন্দ্র ও উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও দুটি কেন্দ্রে গিয়ে ভোটখরার এই দৃশ্য দেখা যায়।

ভোট শেষে বিকেল ৪টার পর আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা টেলিফোনে জানান, এখানকার তিনটি কেন্দ্রের নয় হাজার ৩৯৫ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন এক হাজার ৭৯৩ জন। সে হিসাবে ভোট পড়ার হার ১৯ শতাংশ।

একই চিত্র ছিল ঢাকা-১৭তেও

বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের বর্জনের মুখে আজকের এই নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগ এবং দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জোট-মিত্ররা। ফলে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে কেন্দ্রে ভোটার আনাই ছিল মূল লক্ষ্য।

বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দুই মাসের বেশি সময় ধরে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রচারপত্র বিতরণ করেছে।

শনিবার ও আজ রোববার ভোটের দিনেও হরতাল পালন করেছে তারা। এর মধ্যে ট্রেনে, বাসে, ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে আজ কী পরিমাণ ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন, তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও ছিল।

এ অবস্থায় দুপুর দেড়টার পর ঢাকা-১৮ থেকে মহাখালী ও বনানীতে ঢাকা-১৭ আসনের কিছু কেন্দ্র ঘুরেও ভোটার খরার সেই একই দৃশ্য দেখা গেল।

এসব কেন্দ্রের সামনেও ছিল নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ভিড়। ভেতরটা তেমনই ফাঁকা।

‘নির্বাচনের মতো নির্বাচন হইলে ভোট দিতাম’
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের একটি ভোটকেন্দ্রের সকাল সাড়ে ১০টার চিত্র। ছবি: স্টার

এই আসনের টিঅ্যান্ডটি মহিলা কলেজের দুটি নারী কেন্দ্রে ভোটার ছিল পাঁচ হাজার ৯৯৯ জন। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই দুই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৮৫৪টি। অর্থাৎ এই দুই কেন্দ্রে ভোটের হার ছিল ১৪ দশমিক ২ শতাংশ।

বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মোট সাতটি কেন্দ্র। এর মধ্যে ৬৮, ৬৯, ৭০ ও ৭১ নম্বর কেন্দ্র ছিল পুরুষ ভোটারদের জন্য এবং ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নম্বর কেন্দ্র ছিল নারী ভোটারদের জন্য।

এগুলোর মধ্যে চারটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা জানান, বিকেল ৪টা পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮৯০টি, যেখানে মোট ভোটার ১০ হাজার ৫৮১ জন। অর্থাৎ এই চার কেন্দ্রে পড়া ভোটের হার আট দশমিক চার শতাংশ।

বাকি তিন কেন্দ্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৬৬১টি, যেখানে মোট ভোটার সাত হাজার ৪৭৯ জন।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা-১৮ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী শেরীফা কাদের ভোট দিতে আসেন উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে। ভোট দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ভোটার উপস্থিতি যে খুব কম সেটা স্বীকার করে নেন তিনি।

খানিক পরে লাঙ্গলের প্রার্থীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রের বাইরে ভোট 'দেখতে আসা' এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায় 'এইটা একটা অবাক, সুষ্ঠু ও ভোটারবিহীন নির্বাচন।'

Comments