রেস্তোরাঁ ম্যানেজারকে গুলি করে হত্যা

‘একটা মানুষ না পুরো পরিবারকে খুন করা হয়েছে’

'রোববার দুপুরে বাবাকে বললাম, বাবা বুধবার আমার রেজাল্ট দিবে। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না, পরীক্ষা যেমন দিয়েছো রেজাল্ট তেমনই হবে'
শফিউল আলম কাজলের স্ত্রী আসমা বেগম। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/ স্টার

'রোববার দুপুরে বাবা যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখনই শেষ কথা হয়। তাকে বললাম, বাবা বুধবার আমার রেজাল্ট দিবে। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, "চিন্তা করো না, পরীক্ষা যেমন দিয়েছো রেজাল্ট তেমনই হবে। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই",' কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নুসরাত জাহান শ্রাবণ।

গতকাল সোমবার রাত পৌনে ১১ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শ্রাবণের বাবা শফিউল আলম কাজল (৪৭)।

এর আগে রোববার রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় 'সুলতান ভাই কাচ্চি' নামে রেস্তোরাঁর সামনে সড়কের ফুটপাতের উপর গুলিবিদ্ধ হন তিনি। কাজল ছিলেন ওই রেস্তোরাঁর মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার)।

প্রত্যক্ষদর্শী রেস্তোঁরার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, পানি ও বিদ্যুতের বিল নিয়ে রেস্তোরাঁর মালিক ও যে ভবনে রেস্তোরাঁটি অবস্থিত ওই ভবনের মালিকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে ভবনের মালিক আজহার তালুকদার তার হাতে থাকা পিস্তলের গুলি ছোড়েন। সেসময় গুলিবিদ্ধ হন কাজল। প্রথমে তাকে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে কাজলের বাড়িতে গিয়ে শোকের পরিবেশ দেখা যায়।

মেঝেতে পাতানো বিছানার ওপর বসে কাঁদছেন স্ত্রী আসমা জামান। বড় মেয়ে নুসরাত জাহানও বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন পাশে। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী, ছোট মেয়ে তাসনিয়া তারান্নুম ইকরা (১১) কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বাবার কথা তুলতেই চিবুক বেয়ে পানি পড়তে থাকে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া তরুণী শ্রাবণের। তিনি বলেন, 'বাবা রাতে ঠিকমতো কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়েছি কিনা দেখতেন। না দিলে গায়ে জড়িয়ে দিতেন। বাবা ছাড়া আর কাউকেই আমি কখনও জড়িয়ে ধরিনি। রাতে বাড়িতে ফিরলেই তাকে জড়িয়ে ধরতাম। সেই বাবা নেই আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না'

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন আসমা জামান।

তিনি বলেন, 'পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল আমার স্বামী। রেস্টুরেন্টে অনেক বছর ধরে কাজ করলেও বেতনটা মাত্র বেড়েছিল। সামনে সুখের দিন ছিল। কত স্বপ্ন ছিল, কত আশা ছিল। যা চিন্তা ছিল, স্বপ্ন ছিল সব শেষ। দুই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করবো, কিছুই ভাবতে পারছি না।'

'সাজানো গোছানো সংসার ছিল আমার। আমার স্বামী পরিবারভক্ত মানুষ ছিল। স্ত্রী-কন্যারা কী খাবে, কী পরবে সেইটা নিয়েই সবসময় পড়ে থাকতো। মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারেও সবসময় খোঁজখবর রাখতো। মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও কোনকিছুর কমতি রাখতো না। আমাদের জীবন কী হয়ে গেল!,' কান্নাবিজরিত কণ্ঠে বলেন তিনি।

বিচার দাবি করে তিনি বলেন, 'আমার স্বামীর সঙ্গে কারো কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। কোনো অপরাধ ছিল না তার, অযথাই তাকে গুলি করে মেরে ফেললো। একটা মানুষ না পুরো পরিবারকে খুন করা হয়েছে।'

এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্তের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে শফিউল ইসলাম কাজলের মরদেহ নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় ওই রেস্তোরাঁর সামনে আনা হয়। রেস্তোরাঁর সামনে নবাব সলিমউল্লাহ সড়কে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করেন নিহতের সহকর্মী ও স্বজনরা।

তারা কাজলের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। এই সময় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সেখানে উপস্থিত ছিল।

সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর চাষাঢ়ার বাগে জান্নাত জামে মসজিদে জানাজার নামাজ শেষে কাজলের মরদেহ নিজ গ্রামে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

পৈত্রিক ভিটার ওপর একতলা ভবনের এক ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে থাকতেন শফিউল ইসলাম কাজল। একসময় ব্যবসা করলেও গত ১২ বছর ধরে 'সুলতান ভাই কাচ্চি' নামে রেস্তোরাঁটিতে চাকরি করছেন বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের লোকজন।

 

Comments