বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির স্বাধীনতার শপথ

দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতির শপথ। কারণ, ওই দিন ভাষণটি শোনার পর গোটা জাতি শপথ নেয় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।

দেশের শিক্ষাবিদরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতির শপথ। কারণ, ওই দিন ভাষণটি শোনার পর গোটা জাতি শপথ নেয় এবং দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঐতিহাসিক ৭ মার্চের প্রাক্কালে বাসসকে বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুধু একটি ঐতিহাসিক ভাষণই ছিল না, বরং এটি বাঙালি জাতির জন্য একটি শপথ ছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'ওই দিন বাঙালি শপথ নেয় এবং ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।'

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, 'প্রতিটি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই শক্রর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা যা আছে.... আমি যদি তোমাদের হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা সব বন্ধ করে দিবে।'

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ঐতিহাসিক রেডক্রস ময়দানে এই ভাষণ দেন। ওই দিন সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এই ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য শপথ গ্রহণ করেন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক আরেফিন বলেন, এই ৭ মার্চের ভাষণটি শুধু ভাষণই নয়, বরং এটি একটি মহাকাব্য। আর এ জন্যই ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল নিউজউইক পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে 'পোয়েট অব পলিটিক্স' (রাজনীতির কবি) হিসেবে অভিহিত করেছিল।

তিনি বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের শপথ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালির শপথ।'

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার ভাষণটি আমাদের সঙ্গে ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, '১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি ৭ মার্চের এই ভাষণের মাধ্যমেই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।'

'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশ বাণীসহ অন্যান্য রেডিওতে এই ভাষণটি যখন প্রচারিত হতো তখন এটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো,' তিনি বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এবং বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতার জন্য সম্মিলিতভাবে লড়াইয়ে জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত করেছিল। কারণ, এই ভাষণে স্বাধীনতা লাভের জন্য সব ধরণের নির্দেশ এবং দিকনির্দেশনা ছিল। একটি মাত্র বক্তৃতায় এই মহামানব সমগ্র জাতিকে একটি ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং একটি বাস্তব সার্বভৌম নেতা হিসেবে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এই ভাষণের তাৎপর্য বিজয় অর্জনের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের এই ভাষণ সারা বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক মানুষ ও স্বাধীনতাকামীদের অনুপ্রাণিত করে আসছে। আগামী দিনেও এই ভাষণের প্রাসঙ্গিকতা তাৎপর্য একইভাবে কার্যকর থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপনের জন্য ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন।

তিনি বলেন, তার উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ২০০৪ সাল থেকে এই ভাষণের ওপর সেমিনারের আয়োজন করে আসছে, যা, সাধারণ মানুষ এবং নতুন প্রজন্মর কাছে এই ভাষণকে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অধ্যাপক ড. সামাদ বলেন, শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এবং প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস 'দি হিস্টোরিক সেভেন্থ মার্চ স্পিচ অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: এ ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ' শীর্ষক একটি পুস্তক জাতিসংঘের ৬টি দাপ্তরিক ভাষা আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ ও স্প্যানিশে প্রকাশ করে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্ববিখ্যাত বক্তৃতা সংগ্রহ গ্রন্থ, 'উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইন্সপায়ারড হিস্ট্রি'তেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাসস পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আরেফিন বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি, ভাষণটি নতুন প্রজন্মের সামনে বারবার উপস্থাপন করা আবশ্যক। এই ভাষণটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং এটি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত।'

তিনি বলেন, সেটা যদি করা যায়, এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ব্যক্তিত্ব প্রজন্মের পর প্রজন্ম তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ভাষণটি নিজেই একটি দুর্দান্ত পাঠ্যপুস্তক এবং তরুণদের জন্য এই পাঠ্যপুস্তক শেখানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

ইউনেস্কো বিষয়টি উপলব্ধি করেছে এবং সে কারণেই মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে এটি অন্তর্ভুক্ত করেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আরেফিন আরও বলেন, ভাষণটি ১৯৭১ সালের মতো ২০২৩ সালেও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক এবং ২০৫০ সালের ৭ মার্চেও বাঙালি যখন দিবসটি পালন করবে তখনও ভাষণটির তাৎপর্য একই রকম থাকবে।

তিনি বলেন, 'যদি আমরা ভাষণটির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করি, ভাষণটি তার হৃদয় থেকে খুব সহজে প্রতিফলিত হয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা পাই।'

সুতরাং, বঙ্গবন্ধু যে ভঙ্গিতে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাকে সংলাপও বলা যেতে পারে, কারণ জাতির সামনে সংলাপের ভঙ্গিতে ভাষণ দিয়ে তিনি জনগণের সঙ্গে কথা বলেছেন।

Comments