ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ‘অধিকার হরণের আইন’, বললেন কারাভোগকারীরা

‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে যারা অত্যাচার করে, যারা নির্যাতন করে, যারা শোষণ করে, যারা দুর্নীতি করে, সেই শাসক শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্য।’
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে 'অবৈধ, অন্যায্য ও অধিকার হরণের আইন' হিসেবে অভিহিত করেছেন একটি মানববন্ধনে অংশ নেওয়া বক্তারা।

তারা বলেছেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে শাসক শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্য, জনগণের ভোটাধিকার হরণের কাজ নির্বিঘ্ন করার জন্য এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ সব ধরনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সমালোচনা বন্ধ রাখার জন্য।

আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও একই পত্রিকার প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস এবং যুগান্তরের বিশেষ প্রতিনিধি মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং র‍্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর প্রতিবাদে এই মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।

ডিএসএ ভিকটিমস নেটওয়ার্ক নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত এই মানববন্ধনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাভোগকারী ৪ জন বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তারা আটক হওয়ার পর বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, এই আইনে গ্রেপ্তার দেখানো এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধাপগুলোতে নিজেদের দুর্ভোগের কথাগুলো তুলে ধরেন।

তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মানববন্ধনে কথা বলেন একাধিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের সবার ভাষ্য, এই আইন কেবল সংশোধন করলে হবে না, পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। একইসঙ্গে এই আইনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও তোলেন তারা।

মানববন্ধনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে 'বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য আইন' হিসেবে অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, 'ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কোনোরকম ডিজিটাল সিকিউরিটির জন্য করা হয় নাই। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে যারা অত্যাচার করে, যারা নির্যাতন করে, যারা শোষণ করে, যারা দুর্নীতি করে, সেই শাসক শ্রেণিকে রক্ষা করার জন্য। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে গুম করার জন্য। গুমকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। ভোটাধিকার হরণকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচারকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। দেশের স্বার্থ বিদেশের কাছে বিকিয়ে দেওয়াকে নির্বিঘ্ন করার জন্য।'

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'এই সমস্ত অপকর্মের প্রতিবাদ যারা করেন, এই সমস্ত অপকর্মকে যারা উন্মোচিত করেন, এই সমস্ত অপকর্মের যারা নিন্দা করেন, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য করা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। কাজেই এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় পরিপন্থী আইন। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ ভোটাধিকার হরণ, জনগণের ভাত এবং ভাতের অধিকার হরণ, জনগণকে গুম করা, হত্যা করা, দুর্নীতি করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার করা—মুক্তিযুদ্ধ এগুলোকে সমর্থন করে না।

'এই ধরনের অপকর্ম যারা করে, তাদের রক্ষা করার জন্য করা হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। কাজেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পক্ষে যারা বলে, যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ভিকটিমদের বিপক্ষে বলে তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি।'

বক্তব্যে যে প্রতিবেদনের কারণে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও একই পত্রিকার প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে, সেটা নিয়েও কথা বলেন আসিফ নজরুল।

তিনি বলেন, 'প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল সেটার মূল কথা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য, মানুষের ভাতের কষ্ট হচ্ছে, মানুষের জীবিকার কষ্ট হচ্ছে। এটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? বাংলাদেশের একটা মানুষও অস্বীকার করতে পারে? আমরা সবাই বাজারে যাই। আমরা জানি দ্রব্যমূল্য কী পরিমাণ বেড়েছে, আমরা জানি কিছু লোকের হাতে সমস্ত টাকা কুক্ষিগত হয়েছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, বৈষম্যের হার বেড়েছে, মানুষের কষ্ট বেড়েছে। এমন একটা প্রতিবেদনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে আজকে যারা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপপ্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে, তারাই স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। তারাই স্বাধীনতাকে হেয় করেছে।'

তাই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের পাশাপাশি যারা এটা প্রণয়ন করেছে, যারা এর অপপ্রয়োগ করেছে, তাদের প্রত্যেকের শাস্তির দাবি জানান আসিফ নজরুল।

মানববন্ধনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১০ মাস কারাভোগ করা কিশোরগঞ্জের ইমতিয়াজ কাজল জানান, তাকে মামলা দেওয়া হয়েছিল 'রাতের ভোট' নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণে।

ইমতিয়াজ বলেন, 'সত্য-ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা আমাদের অধিকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে আমাদের অধিকারকে হরণ করেছে। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে যদি ফেসবুকে লেখালেখি করি, যদি কথা বলি, তাহলে আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে।'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক ভুক্তভোগী এন ইউ আহমেদ বলেন, 'আটক করার পর ২ দিন আমাকে গুম করে রাখা হয় বিভিন্ন জায়গায়। ২ দিন পর মামলা দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই আইনটি যে একটি কালাকানুন এবং গুম-খুনের জন্য সহযোগিতাকারী, এটা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। এই আইনের মাধ্যমে সরকার মূলত অপরাধকারীদের আশ্রয় দিচ্ছে।'

একই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ১০ মাস কারাগারে ছিলেন ঢাকার গোলাম মাহফুজ জোয়ারদার। মোট ৭ বার তার জামিন আবেদন নাকচ করা হয়। তিনি কথা বলেছিলেন 'বিচারবহির্ভূত হত্যা' নিয়ে।

গোলাম মাহফুজ বলেন, 'যদি এটাই আমার অপরাধ হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলা, যদি এটাই আমার অপরাধ হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলা, যদি এটাই আমার অপরাধ হয় টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে বলা, যদি এটাই আমার অপরাধ হয় দখলবাজদের বিরুদ্ধে বলা—তাহলে আমাদের তো আর কিছু বলার থাকতে পারে না। কোন দেশে এটা অপরাধ শুধুমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া?'

তার দাবি, অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিলোপ করা হোক। যারা যারা এই আইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।

মানববন্ধনের রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য এবং আরেক ভুক্তভোগী দিদারুল ভূঁইয়া জানান, করোনাকালে সরকারের ত্রাণ সহায়তার অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। তাতে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর তার চোখে ৩ পরতের কালো কাপড় বেঁধে ৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৫ মাস জেল খাটেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমার সেই মামলা এখনো আছে। এতে আমাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়ার সুযোগ আছে।'

মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, 'আজকে এখানে যে নির্যাতিতরা দাঁড়িয়েছেন, তারা সংখ্যায় ৫, ৭ কিংবা ১০ যাই হোক না কেন, তারা বাংলাদেশের কোটি কোটি নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি।'

সাকির ভাষ্য, যেকোনো সময় যে কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকারে পরিণত হতে পারেন। তিনি বলেন, 'এটা মূলত ভয় দেখিয়ে দমন করে শাসনটাকে চিরস্থায়ী করার একটা চেষ্টা।'

সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে সাকি বলেন, 'দেশের মান-ইজ্জত, দেশের মর্যাদা কারা নষ্ট করল? জনগণ? নাকি জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তাদের যারা এই কাজে ব্যবহার করেছে সেই সরকার? এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ব্যবহার করছে কে? আসল অপরাধী হচ্ছে সরকার। সরকার নির্দেশ দিচ্ছে এবং তারা এইভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা করছে এবং এটা করতে করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কতিপয় লোক ভাড়াটে খুনিতে পরিণত হয়েছে।'

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুমের মতে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো আইনগুলো হচ্ছে জুলুমের আইন। এগুলো হচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে আইন, এগুলো জনগণের বিরুদ্ধে আইন, এগুলো জনগণকে নিপীড়ন করার আইন।

মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের (শিশির) আহ্বায়ক রাখাল রাহা, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ঢাকা দক্ষিণের সমন্বয়ক সাধনা মহল, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ড প্রমুখ।

Comments