পথের মায়ায় জীবন বেঁধে নেওয়া ধীরেনরা

ধীরেন শীলের বসবাস কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সরিষাবাড়ী গ্রামে। বাবা নবীন চন্দ্র শীলের কাছ থেকে কাজ শিখে ১২ বছর বয়সে নরসুন্দরের পেশায় আসেন তিনি। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

ধীরেন চন্দ্র শীলের বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। এখনো গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাপিত বা নরসুন্দরের কাজ করেন তিনি। বহু পুরোনো এই পেশায় তার সমসাময়িক এবং উত্তর প্রজন্মের যারা এখনো টিকে আছেন, তাদের বেশিরভাগেরই নির্দিষ্ট দোকান বা সেলুন আছে। কিন্তু ধীরেন শীল এখনো হাটে-বাজারে, গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরেই সেবা দেন।

ধীরেন শীলের বসবাস কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সরিষাবাড়ী গ্রামে। বাবা নবীন চন্দ্র শীলের কাছ থেকে কাজ শিখে ১২ বছর বয়সে এই পেশায় আসেন তিনি। তার বাবাও তার মতো হাটে-মাঠে ঘুরে কাজ করতেন। এলাকায় এখনো তার মতো ৫-৬ জন ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর আছেন।

ধীরেন শীলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত নিন্মআয়ের ও পুরোনো দিনের বয়স্ক মানুষেরাই তার মতো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছে সেবা নেন। এতে চুল কাটাতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা। দাড়ি-গোঁফ কামাতে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

বেলায় বেলায় ৭টি দশক পেরিয়ে আসা ধীরেনের ৩ ছেলে- রনজিত চন্দ্র শীল, সুভাষ চন্দ্র শীল ও সুবোধ চন্দ্র শীল। এরা সবাই বাবার পেশাকেই বেছে নিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সেলুন আছে। কিন্তু ধীরেন নিজে পথের মায়া, পেশার মায়া ছাড়তে পারেননি।

ধীরেন বলেন, 'আমার ছেলেরা আমাকে আর কাজ করতে দিতে চায় না। কিন্তু আমি এই কাজ ছাড়তে পারি না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এই কাজের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই।'

ধীরেন জানান, তিনি এখনো দিনে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এমন অনেকে আছেন, যারা তার কাছে ছাড়া অন্য কারুর কাছে চুল-দাড়ি কাটেন না।

ধীরেনের ধারণা, তিনিসহ আর যে কয়েকজন পথে ঘুরে ঘুরে চুল-দাড়ি কাটেন তারা মারা গেলে আর কোনো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের দেখা পাওয়া যাবে না। সে হিসেবে তারাই এর শেষ প্রজন্ম।

স্থানীয়ভাবে এ ধরনের ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরা পরিচিত 'হাটের নাউয়া' হিসেবে। সমাজে কখনো কখনো তুচ্ছার্থে এই শব্দযুগলের ব্যবহার দেখা যায়।

সরিষাবাড়ী গ্রামের এমন আরেক ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর সুশীল চন্দ্র শীল (৭৪) বলেন, 'একসময় গ্রামের হাট-বাজারে আমাদের কাছেই সবাই চুল-দাড়ি কাটাতেন। এখন সব জায়গায় সেলুন গড়ে ওঠায় আমাদের কাছে তেমন কেউ আসেন না।'

সুশীলের ২ ছেলে। তাদেরও নিজেদের সেলুন আছে। সংসারে কোনো অভাবও নেই। এরপরেও এই পেশা ছাড়তে পারছেন না তিনি। তার ভাষ্য, কাজ করে তিনি তৃপ্তি পান।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামের ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর নারায়ন চন্দ্র শীলের (৭০) বক্তব্যও মোটামুটি একইরকম। তিনি জানান, ছেলেদের চাপে নিয়মিত কাজে বের হওয়া হয় না তারা। তবু সপ্তাহে অন্তত ২ দিন বের হওয়ার চেষ্টা করেন। এখনো তার বাধা কিছু খদ্দের আছে। এ কাজটি না করলে তার ভালো লাগে না।

নারায়ন শীল বলেন, 'আমাদের গ্রামে ২৫ জন ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর ছিলেন। ২০ জন মারা গেছেন। আমরা ৫ জন এখনো মাঝে মাঝে কাজে বের হই।'

পূর্বের স্মৃতি মনে করে একই গ্রামের ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দর সুবল চন্দ্র শীল (৬৭) বলেন, 'আগে গ্রামের প্রত্যেক হাট-বাজারে ২৫ থেকে ৩০ জন নরসুন্দরকে সারবদ্ধভাবে বসে কাজ করতে দেখা যেত। এখন ৫ থেকে ৬ জনের বেশি পাওয়া যায় না।'

ধীরেন, সুশীল, সুবলদের উত্তর প্রজন্ম কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা শহরের নরসুন্দর প্রীতিশ চন্দ্র শীলের (৩৪) ভাষ্য, 'আমরা এখন সেলুনে কাজ করি। আমার বাবা সতীশ চন্দ্র শীল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরের কাজ করতেন। কিন্তু তাদের মতো খোলা আকাশের নিচে বসে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।'

রাজারহাটের সরিষাবাড়ী গ্রামের কৃষি শ্রমিক মোজাম্মেল হক (৫৫) এখনো ভ্রাম্যমাণ নরসুন্দরদের কাছে চুল-দাড়ি কাটাতে অভ্যস্ত। একই গ্রামের প্রণব চন্দ্র বর্মণও (৭০) সেরকম। কারণ হিসেবে তারা বলেন, এখানে খরচ কম। বাইরের খোলা পরিবেশে তারা স্বস্তিও বোধ করেন।

প্রণব বলেন, 'এই যুগের ছেলেদের কেউ হাটের নাউয়াদের কাছে চুল-দাড়ি কাটাতে চায় না। এদের সংখ্যাও কমে এসেছে। তাই আমরা যারা বয়স্করা আছি তারা মরে গেলে হয়তো এদের কাছে যাওয়ারও কেউ থাকবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

7h ago